দালীলিক প্রামাণপঞ্জির আয়নায় কথিত আহলে হাদীস ভ্রান্ত মতবাদ



১৬ই জানুয়ারী ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে শাইখুল হাদীস মুফতী মনসূরুল হক দা.বা. এক ঐতিহাসিক বয়ান পেশ করেন। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব উপলব্ধি করে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত আকারে বয়ানটি আপনাদের খেদমতে পেশ করা হল।

ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করার পর যখন বুঝতে পারল জেল-যুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন এবং খুন-গুম করে এদেশের মুসলমানদেরকে দমন করা সম্ভব নয়। সত্যিকার মুসলিম জনতা চির স্বাধীন, অন্যায় ও অসত্যের কাছে তারা কখনো মাথা নত করে না, তখন তারা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, বাগে আনতে হলে মুসলমানদেরকে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত করে দিতে হবে। ইংরেজ সরকার তাদের এ স্কিম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাদের অনুগত চারজন লোকের মাধ্যমে মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে চার ধরনের ফিৎনা ছড়িয়ে দিল। এগুলোর অন্যতম ছিল, আহলে হাদীস ফিৎনা। মৌলভী আব্দুল হক বেনারসীর (মৃত্যু:১২৭৫ হি.) উদ্ভাবিত মৃতপ্রায় এই মতবাদকে পুনঃজীবিত করার লক্ষ্যে ইংরেজ সরকার মুহাম্মাদ হুসাইন আহমদ বাটালবীকে বেছে নেয়। বাটালবী সাহেব সরলমনা মুসলমানদের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে হাদীস মানার চটকদার বুলি আওড়ে এক ভয়াবহ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেন। আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের অনুসারী মাযহাব মেনে চলা মুসলমানদেরকে তিনি কাফের-মুশরিক বলে ফতোয়া দেন। ‘ইংরেজ শাসন আল্লাহর রহমত, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম’- এ ধরনের মারাত্মক বিষও তার কলম উগরে দেয়।

শুরুর দিকে এ দলটি নিজেদেরকে মুহাম্মাদী, সালাফী, লা-মাযহাবী, ওয়াহাবী, আছারী ইত্যাদি বলে পরিচয় দিত। কিন্তু এসব পরিচয়ে তারা তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। তাই বাটালবী সাহেব ইংরেজ সরকার বরাবর দরখাস্ত করলেন “আমার সম্পাদিত এশায়াতুস সুন্নাহ পত্রিকায় ১৮৮৬ইং সনে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওয়াহাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমকহারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার করা সমীচীন হবে না যাদেরকে আহলে হাদীস বলা হয় এবং যারা সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমকহালালী, আনুগত্য ও কল্যাণই কামনা করে যা বারবার প্রমাণিতও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি-পত্রেও এর স্বীকৃতি আছে। অতএব এ দলের প্রতি ওয়াহাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং গভর্নমেন্ট বরাবর অত্যন্ত আদব ও সবিনয় নিবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এই ওয়াহাবী শব্দ রহিত করে আমাদের উপর তা প্রয়োগের নিষেধাজ্ঞা জারী করা হোক। -আপনার অনুগত আবূ সাঈদ মুহাম্মাদ হুসাইন, সম্পাদক এশায়াতুস সুন্নাহ”।

অনুগত বান্দার এ আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নর দফতর থেকে “তার দরখাস্ত মঞ্জুর করা হল এবং তাদের জন্য আহলে হাদীস নাম সরকারীভাবে বরাদ্দ করা গেল”-মর্মে চিঠি পাঠানো হয়। সরকারের তরফ থেকে পাঠানো সেসব চিঠির তালিকা লক্ষ্য করুন- পাঞ্জাব গভর্নর সেক্রেটারি মি. ডব্লিউ এম এন- চিঠি নং ১৭৫৮, সি পি গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ৪০৭, ইউ পি গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ৩৮৬, বোম্বাই গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ৭৩২, মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ১২৭, বাঙ্গাল গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ১৫৫ (সূত্র: এশায়াতুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা ৩২-৩৯, সংখ্যা ২, খণ্ড ১১)।

আহলে হাদীস খেতাব বরাদ্দ পেয়ে বাটালবী সাহেব দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে হাদীস মানার নামে মুসলমানদেরকে গোমরাহ করেন। এ কাজে তিনি নিজের সবটুকু শ্রম-সাধনা ইংরেজের সন্তুষ্টি অর্জনে বিলিয়ে দেন। তারপর কুদরতের কারিশমা দেখুন, পঁচিশ বছর পর সেই এশায়াতুস সুন্নাহ পত্রিকায় সেই মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালবী লিখলেন ‘যে ব্যক্তি ঈমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যেতে চায় তার জন্য সহজ পথ হল, তাকলীদ ছেড়ে দেয়া।’ (সূত্র: এশায়াতুস সুন্নাহ, খণ্ড ১১, সংখ্যা ২, পৃষ্ঠা ৫৩)। এ যেন নিজের হাঁড়ি নিজেই হাটে ভাঙ্গার নামান্তর।

বাটালবী সাহেব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ইংরেজের সেবা করে গেছেন। ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করে। তিনি মরে গেছেন কিন্তু তার বই-পুস্তক আর ভ্রান্ত মতবাদ আজও রয়ে গেছে। সেগুলোর মাধ্যমে এখনো হাজার হাজার মুসলমান গোমরাহ হচ্ছে।

আমাদের দেওবন্দী আকাবিরদের প্রতিরোধের মুখে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত আহলে হাদীস ফিৎনার দরজা বন্ধ ছিল। কিন্তু আমাদের অলসতার সুযোগে তারা আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এতদিন তারা গর্তে লুকিয়ে ছিল, এখন বের হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। মাযহাব মানার স্বরূপ না বুঝে কিংবা জেনে বুঝেই হঠকারিতা বশতঃ তারা বলে, আমরা নাকি ইমাম আবূ হানীফা রহ.কে নবী মেনে কাফির হয়ে গেছি। আশ্চর্য! আমরা কিভাবে আবূ হানীফাকে নবী মানলাম? নবীর তো প্রতিটি আদেশ-নিষেধই উম্মতকে মেনে চলতে হয়। অথচ আমরা তো বহু মাসআলায় আবূ হানীফা রহ. এর তাকলীদই করি না। কারণ সেগুলো এতটাই স্পষ্ট যে, কোনরূপ ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। অনুরূপ হাজারও মাসআলায় হানাফী মুফতীগণ সাহেবাইনের মতানুযায়ী ফাতাওয়া দিয়ে থাকেন। তাহলে কিভাবে আমরা ইমাম আবূ হানীফাকে নবী মানলাম? তাছাড়া সব বিষয়েই কি ইমামের তাকলীদ করা হয়? তাকলীদ তো করা হয় এমন কিছু জটিল বিষয়ে যার সমাধান কুরআন-হাদীসে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। অনুরূপ একই বিষয় যখন বাহ্যতঃ সাংঘর্ষিক একাধিক বিধান পাওয়া যায় তখন কোনটা নাসেখ আর কোনটা মানসূখ তা আমরা জানি না বা বুঝতে পারি না। তাই এ জাতীয় ক্ষেত্রে আমরা খাইরুল কুরূনের মুজতাহিদ ইমামদের বুঝ ও উপলব্ধিকে আমাদের বুঝ ও উপলব্ধির চেয়ে শতগুণ উত্তম মনে করে তাদের বুঝ-উপলব্ধির অনুসরণ করি। আমরা কখনই তাদের ব্যক্তি সত্তার পূজা করি না। এটাই তাকলীদের মূল কথা। কিন্তু যেসব বিষয় কুরআন-সুন্নাহয় স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ রয়েছে যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, রমাযান মাসে রোযা রাখা, যাকাত দেয়া, হজ্ব করা এ জাতীয় শত শত বিষয়ে আমরা কোন ইমামের ব্যাখ্যার অপেক্ষা করি না। অর্থাৎ তাদের তাকলীদের প্রয়োজন অনুভব করি না। কারণ এসব বিষয় কুরআন-সুন্নাহ থেকে আমরাই স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তাহলে বলুন, এভাবে তাকলীদ করার কারণে আমরা কিভাবে কাফির-মুশরিক হয়ে গেলাম?

আহলে হাদীস নামক এই ভ্রান্ত মতবাদকে নতুন করে চাঙ্গা করেছেন মরহুম নাসিরুদ্দীন আলবানী। তার বাড়ী সিরিয়ার আলবেনিয়া নামক স্থানে। তার পিতা নূহ নাজাতী রহ. হানাফী মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় আলেম ছিলেন। ছেলের বিতর্কিত আচরণে অধৈর্য হয়ে ছেলেকে তিনি ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। সিরিয়ার জনগণ মরহুম আলবানীকে বিতর্কিত মতবাদের কারণে সিরিয়া থেকে বহিষ্কার করে দেয়। তারপর তিনি সৌদিআরবে আশ্রয় নেন। এক পর্যায়ে সৌদির আলেম উলামা ও জনসাধারণও তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ফলে সরকারী নির্দেশে ১৯৯১ সালে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তিনি আরবভূমি ছাড়তে বাধ্য হন। সেখান থেকে পালিয়ে তিনি জর্ডানে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই ১৯৯৯ইং সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার কোন নিয়মতান্ত্রিক উস্তাদ ছিল না। ব্যক্তিগত গবেষণা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে যা বুঝেছেন তাই লিখে গেছেন। এ ব্যাপারে তার বিশেষ অবদান(?) হল, তিনি হাদীসসমূহকে সহীহ, যঈফ দুই ভাগে বিভক্ত করে দু’টি কিতাব সংকলন করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি যঈফ হাদীসের সংকলনের সাথে মউযূ’ হাদীসকে মিলিয়ে উভয়টিকে একাকার করে ফেলেছেন এবং যঈফ, মউযূ’র সমন্বিত সংকলনের নাম দিয়েছেন

سلسلة الاحاديث الضعيفة والموضوعة وأثرها السئ فى الامة

এখন প্রশ্ন হল, যঈফ আর মউযূ’ কি এক জিনিস, উভয়টির ক্ষেত্রে কি একই বিধান প্রযোজ্য হয়? মউযূ’ তো হাদীসই নয়; এটাতো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণা। অথচ যঈফ তো হাদীস। ضعف (যু’ফ) হল, সনদের সিফাত; হাদীসের সিফাত নয়। যেমন, সহীহ, হাসান এগুলো সনদের সিফাত; হাদীসের সিফাত নয়। এগুলো দ্বারা তো সনদের অবস্থা বুঝানো হয়। যঈফ হাদীস যদি একাধিক সনদে আসে তখন এর দ্বারা হুকুমও সাবেত হয়। অনুরূপ যঈফ হাদীস যদি উম্মত কবুল করে নেয় তাহলে তা সহীহ’র মতো হয়ে যায়। যেমন, لا وصية لوارث এই হাদীসের সনদ তো যঈফ কিন্তু উম্মত এটাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে বলে তা মা’মূলবিহী হয়েছে এবং এর দ্বারা হুকুমও সাবেত হয়েছে। অনুরূপ طلب العلم فريضة على كل مسلم

এই হাদীসটি পঞ্চাশটি সনদে এসেছে। (ইবনে মাজাহ, ২২৪ নং হাদীসের টীকা)। কিন্তু প্রত্যেকটি সনদই যঈফ। তথাপি এতগুলো সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে হাদীসটি হাসান লিগাইরিহী হয়ে গেছে। ফলে এর দ্বারা ফরযের মতো গুরুত্বপূর্ণ হুকুম সাবেত করা হয়েছে। আর যঈফ হাদীস যদি হাসান লিগাইরিহী পর্যন্ত না-ও পৌঁছে তবুও তা মউযূ’র মতো বেকার নয়। বরং কিছু শর্ত সাপেক্ষে ফযীলতের ক্ষেত্রে তা আমলযোগ্য। তাহলে বলুন, হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে যার ন্যূনতম জ্ঞানও রয়েছে তার পক্ষে যঈফ আর মউযূ’কে এক মনে করা কিভাবে সঠিক হতে পারে? বর্তমানে আরব বিশ্বে আলবানী সাহেবের বিরুদ্ধে বহু কিতাব লেখা হচ্ছে। তার মধ্যে তানাকুযাতে আলবানী নামক কিতাবটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। লেখক এই কিতাবে আলবানী সাহেবের স্ববিরোধী কথা ও কাজগুলো দায়িত্বের সাথে তুলে ধরেছেন। তিনি সেখানে দেখিয়েছেন, আলবানী সাহেব কোনো একটি হাদীস তার মতের পক্ষে হওয়ায় সেটাকে সহীহ বলেছেন। আবার ঐ একই সনদে বর্ণিত হাদীস দ্বারা যখন তার বিরোধী পক্ষ দলীল দিয়েছেন তখন সেটাকে নির্দ্বিধায় যঈফ বলে দিয়েছেন। এ জাতীয় বহু ঘটনা ঐ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘আহলুল হাদীস’ মূলতঃ হাদীস বিশারদ ও শাস্ত্র-বিশেষজ্ঞ ইমামদের উপাধি। ১২৪৬ হিজরীর পূর্বে ফেরকা ও সম্প্রদায়ের আদলে পৃথিবীতে আহলে হাদীস নামে কোন দলের অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমানের আহলে হাদীস ফেরকা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে এ কথার দাবী করে যে, তারা সর্ব ক্ষেত্রে হাদীস মেনে চলে। অথচ হাদীসের কিতাবে দেখা যায়, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে কোথাও হাদীস মানতে বলেননি; বরং তিনি যেখানেই তাঁকে মানতে ও অনুসরণ করতে বলেছেন সেখানে সুন্নাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি উম্মতকে সুন্নাহ অনুসরণ করতে বলেছেন, সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে বলেছেন; হাদীস অনুসরণ করতে কিংবা আঁকড়ে ধরতে বলেননি। বরং তিনি গোমরাহ ফেরকার কার্যক্রম বুঝাতে গিয়ে হাদীস শব্দ ব্যবহার করেছেন। সহীহ মুসলিমের সাত নং হাদীস এ কথার সুস্পষ্ট প্রমাণ। তিনি বলেন, শেষ যামানায় অনেক প্রতারক ও মিথ্যুক লোকের আবির্ভাব হবে। তারা তোমাদের কাছে এমন হাদীস পেশ করবে যা তোমরাও শোননি, তোমাদের পূর্বপুরুষগণও শোনেনি। সাবধান! তারা যেন তোমাদেরকে গোমরাহ করতে না পারে।

বস্তুতঃ হাদীস ও সুন্নাহ এক জিনিস নয়, এ দু’য়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আমাদের আকাবিরগণ তাদের বিভিন্ন কিতাবে হাদীস ও সুন্নাহর পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। যার সারকথা হল, উম্মতের জন্য দ্বীনের উপর চলার অনুসরণীয় পথকে সুন্নাহ বলে। আর প্রত্যেক সুন্নাহই হাদীস কিন্তু সকল হাদীস সুন্নাহ নয়। অর্থাৎ সকল হাদীসই উম্মতের জন্য দ্বীনের উপর চলার অনুসরণীয় পথ নয়। কেননা হাদীসের মধ্যে বহু হাদীস এমন আছে যেগুলোর বিধান রহিত হয়ে গিয়েছে। উদাহরণতঃ

বুখারী শরীফের কিতাবুল জানায়েযের ১৩০৭ থেকে ১৩১৩ নং হাদীসসমূহ। এসব হাদীসে জানাযা বহন করে নিয়ে যেতে দেখলে সকলকে দাঁড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে। অথচ এই বিধান অন্যান্য সহীহ হাদীস দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। (উমদাতুল ক্বারী ৬/১৪৬)

ইসলামের প্রথম যুগে নামাযরত অবস্থায় কথা বলা, সালাম দেয়া, সালামের উত্তর দেয়া সবই বৈধ ছিল। কিন্তু পরবর্তিতে এই বিধান রহিত হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী হা. নং ১১৯৯, ১২০০)

ইসলামের প্রথম যুগে বিধান ছিল যে, আগুনে রান্নাকৃত খাদ্য গ্রহণ করলে উযু ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু পরবর্তিতে এই বিধান রহিত হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী হা. নং ২০৮)

নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের পর মদীনায় ১৬/১৭ মাস বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায় করেছেন। কিন্তু পরবর্তিতে এই বিধান রহিত হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী হা. নং ৭২৫২) এগুলোর সবই সহীহ হাদীস কিন্তু সুন্নাহ নয়। অর্থাৎ এ হাদীসগুলো উম্মতের জন্য অনুসরণীয় নয়।

এমন অনেক হাদীস আছে যার বিধান নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নির্দিষ্ট। উম্মতের জন্য তার উপর আমল করা বৈধ নয়। যেমন, বহু হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এগারটি বিবাহের কথা এবং মহর দেওয়া ছাড়া বিবাহ করার কথা এসেছে। তো এগুলো হাদীস বটে কিন্তু উম্মতের জন্য অনুসরণীয় নয়। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ ১১/১৪৩-২১৭)

হাদীসে এমন অনেক আমলের কথা বর্ণিত আছে যা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোন বিশেষ প্রয়োজনে করেছেন। যেমন, কোমরে ব্যথা থাকার কারণে কিংবা এস্তেঞ্জা করার স্থানে বসার দ্বারা শরীরে বা কাপড়ে নাপাকী লাগার আশঙ্কায় তিনি সারা জীবনে মাত্র দুই বার দাঁড়িয়ে পেশাব করেছেন। কিন্তু হাদীসের বর্ণনায় এসব কারণের কথা উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে পেশাব করার কথা আলোচিত হয়েছে। তো এই হাদীসের উপর আমল করে কি দাঁড়িয়ে পেশাব করাকে সুন্নাত বলা যাবে? অনুরূপভাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় এবং রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন। (সহীহ বুখারী হা. নং ১৯৩৮)। তাই বলে কি ইহরাম ও রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগানোকে সুন্নাত বলা যাবে?

কাজটি বৈধ একথা বুঝানোর জন্যও নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক কাজ করেছেন। যেমন, তিনি একবার তাঁর নাতনী উমামা বিনতে যয়নবকে কোলে নিয়ে নামায পড়িয়েছেন। (সহীহ বুখারী হা. নং ৫১৬)। আরেকবার রোযা অবস্থায় তাঁর এক স্ত্রীকে চুম্বন করেছেন। (সহীহ বুখারী হা. নং ১৯২৮)। এই উভয় ঘটনাই হাদীসে এসেছে। এর দ্বারা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শিশু কোলে নিয়ে নামায পড়া বা পড়ানো যেতে পারে এবং রোযা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা বৈধ, এতে রোযার কোন ক্ষতি হবে না। তাই বলে কি সব সময় শিশু কোলে নিয়ে নামায পড়ানোকে কিংবা রোযা অবস্থায় স্ত্রী চুম্বনকে সুন্নাত বলা যাবে?

উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হল, আহলে হাদীস নামটিই সঠিক নয়। কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন বর্ণনায় উম্মতকে হাদীস মানতে বলেননি, বলেছেন সুন্নাত মানতে। তারপরও যারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে দাবী করে তাদের উচিৎ এগারটি বিবাহ করা, মহর ছাড়া বিবাহ করা, ইহরাম ও রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগানো, রোযা অবস্থায় স্ত্রী চুম্বন করা, দাঁড়িয়ে পেশাব করা ইত্যাদিকে সুন্নাত মনে করে আমল করা। অনুরূপ জীবনে মাত্র তিন দিন মসজিদে এসে তারাবীহ পড়া, নামাযরত অবস্থায় কথা বলা, সালাম দেয়া, সালামের উত্তর দেয়া। কারণ এগুলোও তো হাদীসে এসেছে। কিন্তু তারা তো এসব করে না। তাহলে হাদীস মানার দাবীদার হয়ে এসব হাদীসের উপর আমল না করে কিভাবে তারা আহলে হাদীস হল? আসল কথা হল, তারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বললেও বাস্তবে তা বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিকে যেহেতু নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে বলেছেন তাই আমরা মাযহাব অনুসারীগণ হাদীসের শুধুমাত্র সুন্নাহ অংশের অনুসরণ করি এবং নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ বলে পরিচয় দিই। অর্থাৎ আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত মানি এবং সাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে অনুসরণ করি।

নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে ও মানতে বলেছেন। এ সম্পর্কীয় কয়েকটি হাদীস লক্ষ্য করুন,

১. المتمسك بسنتي عند فساد امتي له اجر شهيد. المعجم الأوسط لأبى القاسم الطبراني (৫/৩১৫)

২. تركت فيكم أمرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنة نبيه. الموطأ بروايتين (৫/৮৯৯)

৩. من أحيا سنة من سنتي قد أميتت بعدي فإن له من الأجر مثل من عمل بها. سنن الترمذي لمحمد الترمذي (৫/৪৫)

৪. من أحيا سنتي فقد أحبني ومن أحبني كان معي في الجنة. سنن الترمذي لمحمد الترمذي (৫/৪৬)

৫. من أكل طيبا وعمل في سنة وأمن الناس بوائقه دخل الجنة. سنن الترمذي لمحمد الترمذي (৪/৬৬৯)

৬. ستة لعنتهم ولعنهم الله ...... والتارك لسنتي. سنن الترمذي لمحمد الترمذي (৪/৪৫৭)

৭. تمسك بسنة خير من إحداث بدعة. مسند أحمد بن حنبل (৪/১০৫)

৮. ما من نبي بعثه الله في أمة قبلي إلا كان له من أمته حواريون وأصحاب يأخذون بسنته. صحيح مسلم (১/৬৯)

৯. عليكم بسنتى وسنة الخلفاء المهديين الراشدين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ. سنن أبي داود (৪/৩১৬)

১০. فعليكم بما عرفتم من سنتى وسنة الخلفاء الراشدين المهديين. سنن ابن ماجة للقزويني (১/১৫)

এখানে মাত্র দশটি হাদীস উল্লেখ করা হল। এসব হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে বলেছেন, সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতে বলেছেন এবং সুন্নাহ তরককারীর উপর লা’নত করেছেন। একটি বর্ণনায়ও তিনি শুধু হাদীসকে (যা সুন্নাহর পর্যায়ে পৌঁছেনি) আঁকড়ে ধরতে বলেননি। আহলে হাদীস ভাইয়েরা গ্রহণযোগ্য এমন একটি হাদীসও পেশ করতে পারবেন কি যার মধ্যে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে হাদীস আঁকড়ে ধরতে বলেছেন কিংবা হাদীস অনুযায়ী উম্মতকে চলতে বলেছেন? হ্যাঁ, তিনি হাদীস রেওয়ায়েত করতে বলেছেন, অন্যের কাছে পৌঁছাতে বলেছেন। কিন্তু হাদীস আঁকড়ে ধরতে বলেননি বা হাদীস অনুযায়ী আমল করতে বলেননি। আমল করার জন্য তো হাদীসকে সুন্নাহ পর্যায়ে পৌঁছতে হয়।

আহলে হাদীস ফেরকা তাকলীদকে শিরক বলে। অথচ তারা তাদের দাবী প্রমাণে বুখারী মুসলিম এ ধরনের যেসব হাদীসের কিতাব থেকে দলীল দেয় সেসব কিতাবের কোথাও তাকলীদকে শিরক বলা হয়নি; বরং এগুলোর লেখক সবাই কোন না কোন মুজতাহিদ ইমামের তাকলীদ করতেন। যেমন, ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শাফিয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। (তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাহ, ১/৪২৫-৪২৬)। ইমাম আবূ দাঊদ ও ইমাম নাসায়ী হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। (মা‘আরিফুস সুনান, ১/৮২-৮৩)। প্রশ্ন হল, তাকলীদ করার কারণে কেউ যদি মুশরিক হয়ে যায় তাহলে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী কুতুবে সিত্তার ছয় জন লেখকই মুশরিক সাব্যস্ত হবেন (নাউযুবিল্লাহ)। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাঁদের কিতাব দিয়ে দলীল দেয় কেন? মুশরিকদের(?) লেখা কিতাব দিয়ে শরঈ বিষয়ে দলীল দেয়া জায়েয হবে কি?

আহলে হাদীস ভাইয়েরা হাদীসের ক্ষেত্রে সহীহ, যঈফ ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন। এগুলোও তারা তাকলীদকারীদের কিতাব থেকেই শিখেছেন। কারণ উসূলে হাদীসের পুরনো সব কিতাব তাকলীদকারী আলেমগণেরই লেখা। এর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা লক্ষ্য করুন, ১.নুখবাতুল ফিকার (ইবনে হাজার আসকালানী শাফেয়ী) ২.মুকাদ্দামাতু ইবনিস সালাহ (ইবনুস সালাহ শাফেয়ী) ৩.মুকাদ্দামাতুশ শাইখ (আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী হানাফী) ৪.আত্ তাসবিয়াতু বাইনা হাদ্দাসানা ওয়া আখবারানা (ইমাম ত্বহাবী হানাফী) ৫.তাওজীহুন নযর (তাহের ইবনে সালাহ জাযায়েরী হানাফী) ৬.তাওযীহুল আফকার (আমীরে সান‘আনী হানাফী) ৭.শরহু শরহি নুখবাতিল ফিকার (মুল্লা আলী ক্বারী হানাফী) ৮. ক্বাফুল আসার ফী সাফ্ফি উলূমিল আসার (রযীউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম হানাফী) ৯. ইম্‘আনুন নযর (শাইখ আকরাম সিন্ধী হানাফী) ১০. আর রাফ্ঊ ওয়াত তাকমীল (আব্দুল হাই লাখনুবী হানাফী) ১১.আল ইল্মা (কাযী ইয়ায মালেকী) ১২.আত্ তাক্বয়ীদ ওয়াল ঈযাহ (ইবনে রজব হাম্বলী)। অনুরূপ উসূলে হাদীসের উপর যত কিতাব আছে সবই কোন না কোন মুকাল্লিদ ও মাযহাবের অনুসারী লিখেছেন। প্রশ্ন হল, তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এসব মুশরিকদের(?) কিতাব থেকে নেয়া হাদীস শাস্ত্রের এ সকল পরিভাষা তাদের জন্য ব্যবহার করা কিভাবে বৈধ হবে?

মাযহাব অস্বীকারকারী তথাকথিত আহলে হাদীসদের কোন ধারাবাহিক সিলসিলা নেই। তাদের জন্মই হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের গর্ভে। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ দখল করার আগে তাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। থাকলে তারা ১২৪৬ হিজরীর পূর্বে আহলে হাদীস সম্প্রদায় কর্তৃক লেখা হাদীস, উসূলে হাদীস, তাফসীর, উসূলে তাফসীর, ফিকহ ও উসূলে ফিকহ সম্পর্কীয় কোন কিতাব পেশ করুক। তাদের প্রতি আমাদের চ্যালেঞ্জ, সম্ভব হলে তারা উপরোক্ত ছয় বিষয়ে তাদের লিখিত অন্ততঃ ছয়টি কিতাব দেখাক। তবে অবশ্যই সেটা ১২৪৬ হিজরীর পূর্বের লেখা হতে হবে। বস্তুতঃ তাফসীর, হাদীস ও ফিকহ সম্পর্কে লিখিত যেসব কিতাব পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান তার সবই কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী কিংবা মুজতাহিদের লেখা। কি আশ্চর্য বৈপরীত্য! মাযহাব অনুসারীদের কিতাব পড়ে পড়ে গলাবাজী করবে আবার তাদেরকে কাফির-মুশরিকও বলবে!

এ প্রসঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতী, মাহমূদ হাসান গঙ্গুহী রহ. বর্ণিত একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, হযরত মাওলানা ইবরাহীম বালিয়াবী রহ. বলেছেন, আমার একজন আহলে হাদীস উস্তাদ ছিলেন। তিনি ফাতাওয়াও লিখতেন। একদিন তার কামরায় প্রবেশ করে দেখি, তিনি ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব হিদায়া ও ফাতাওয়ায়ে আলমগীরিয়া অধ্যয়ন করছেন। আমি বিস্মিত হয়ে তাকে বললাম, জনাব! আপনি আহলে হাদীস হয়েও হানাফীদের কিতাব অধ্যয়ন করছেন? তিনি বললেন, এসব কিতাব ছাড়া জুযইয়্যাত (শাখাগত বিভিন্ন মাসআলার সমাধান) আর কোথায় পাব? ফাতাওয়া তো এসব কিতাব দেখেই দেই কিন্তু দলীলের আলোচনায় এগুলোর নাম উল্লেখ করি না। বরং হিদায়ার মাসআলার দলীল হিসেবে হিদায়ার মতন ও টীকায় যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো উল্লেখ করে লিখে দেই এই মাসআলাটি উক্ত হাদীস থেকে সাবেত হয়েছে। (মালফূযাতে ফকীহুল মিল্লাত, ২/৯১)। বুঝুন অবস্থা! মুকাল্লিদদের কিতাব ছাড়া একটি কদমও চলে না আবার গলাবাজীর ধারও কমে না।

আহলে হাদীস সম্প্রদায় যদিও প্রচার করে যে, তারা কারো তাকলীদ করে না। কিন্তু বাস্তবে তারা মুহাদ্দিসীনে কেরামের তাকলীদ করে থাকে। কারণ তারা কোন বিষয়ের দলীল হিসেবে বুখারী, মুসলিম ও হাদীসের অন্যান্য কিতাব থেকে দলীল পেশ করে থাকে। এর অর্থ হল, তারা এসব মুহাদ্দিসীনে কেরামকে নির্দ্বিধায় অনুসরণ করে। আর এটাই তো তাকলীদ। অথচ বড় বড় মুহাদ্দিসীনে কেরাম নিজেরা ফাতাওয়া না দিয়ে ফাতাওয়ার জন্য জনসাধারণকে ফকীহদের কাছে যেতে বলতেন। এ ব্যাপারে ইমাম তিরমিযী রহ. এর মন্তব্যটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি সুনানে তিরমিযীর কিতাবুল জানায়েযের এক হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, هكذا قال الفقهاء وهم اعلم بمعانى الحديث ‘ফকীহগণ এই হাদীসের ব্যাপারে এমনটিই বলেছেন আর তারা হাদীসের মর্ম সবচেয়ে ভাল জানেন’। (তিরমিযী, হা. নং ৯৯০)

মুহাদ্দিসীনে কেরাম ফাতাওয়ার জন্য লোকদেরকে মুজতাহিদ ইমামদের দারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিতেন এ রকম দু’টি ঘটনা লক্ষ্য করুন-

এক, সুলাইমান ইবনে মেহরান আল আ’মাশ রহ. এর কাছে এক ব্যক্তি ফাতাওয়া জানতে আসল। তিনি তাকে ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. ছিলেন সুলাইমান ইবনে মেহরানের হাদীসের ছাত্র। আবূ ইউসুফ রহ. প্রশ্নকারীকে সন্তোষজনক জবাব প্রদান করলেন। ইমাম আ’মাশ রহ. আশ্চর্য হয়ে আবূ ইউসুফ রহ. কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই জবাব কিভাবে দিলে? তিনি বললেন, জনাব! গতকাল আপনি যে হাদীস পড়িয়েছেন তার মধ্যেই তো এই প্রশ্নের জবাব রয়েছে। বিস্মিত ইমাম আ’মাশ মন্তব্য করলেন, انتم الاطباء ونحن الصيادلة আসলে তোমরা হলে ডাক্তার আর আমরা কেবল ওষুধ বিক্রেতা। অর্থাৎ ওষুধ বিক্রেতার কাছে ওষুধের ভাণ্ডার থাকে কিন্তু কোন ওষুধ কোন রোগের জন্য তা তার জানা থাকে না। ঠিক তেমনই যে মুহাদ্দিস মুজতাহিদ নন তার কাছে হাদীস তো প্রচুর থাকে কিন্তু হাদীস দ্বারা কোন্ মাসআলা প্রমাণিত হয় তা তার জানা থাকে না। (আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহী লিস্ সায়মারী, পৃষ্ঠা ১২-১৩)

দুই, সদরুদ্দীন রহ. মানাকেবে আবী হানীফা নামক কিতাবে লিখেছেন, একবার উস্তাযুল মুহাদ্দিসীন ইয়াযীদ ইবনে হারূন রহ. এর নিকট এক ব্যক্তি ফাতাওয়া জানতে আসল। তখন তার নিকট উপস্থিত ছিলেন তার বিশিষ্ট শাগরেদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, যুহাইর ইবনে হারব প্রমূখ মুহাদ্দিসীনে কেরাম। তিনি ঐ ব্যক্তিকে বললেন, ‘ফাতাওয়ার জন্য এখানে এসেছো কেন? আহলে ইলমদের কাছে যাও।’ হযরত আলী ইবনুল মাদীনী রহ. বিস্মিত হয়ে বললেন, হুযূর! আপনার নিকট উপস্থিত এই বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারীগণ কি আহলে ইলম নন?! তিনি বললেন, না, তোমরা আহলে ইলম নও, তোমরা তো হলে আহলুল হাদীস (অর্থাৎ হাদীস বিশারদ) আহলে ইলম হল, আবূ হানীফার শিষ্যগণ। (ইরশাদুল কারী, পৃষ্ঠা ৩২)

দেখা যাচ্ছে, বড় বড় মুহাদ্দিসগণ ফাতাওয়ার জন্য জনসাধারণকে মুজতাহিদ ফকীহদের দারস্থ হতে বলছেন। এখন তথাকথিত আহলে হাদীসদেরকে প্রশ্ন করা যেতে পারে, তারা যেসব মুহাদ্দিস ইমামদের তাকলীদ করে থাকেন সেই মুহাদ্দিস ইমামগণ জনসাধারণকে যেসব ফকীহদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন তারা এদেরকে মানেন না কেন? এবং এ ক্ষেত্রে তারা তাদের মুহাদ্দিস ইমামদের অনুসরণ করেন না কেন? তাদের কাছে এই প্রশ্নের কোন গ্রহণযোগ্য জবাব আছে কি? উপরন্তু মুহাদ্দিস ইমামগণ মুজতাহিদ ফকীহদেরকে মান্যবর মনে করার কারণে মুহাদ্দিসগণকেও কি তারা মুশরিক বলার হিম্মত রাখেন?

আহলে হাদীস সম্প্রদায় ইজমা কিয়াসকে শরী‘আতের দলীল মানে না। অথচ ইজমা কিয়াস শরী‘আতের দলীল হওয়ার বিষয়টি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। ইজমা দলীল হওয়া সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াত

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا.

দ্বারা প্রমাণিত। এই আয়াত দ্বারা মুফাসসির এবং উসূলবিদ উলামায়ে কেরাম ইজমাকে শরী‘আতের দলীল প্রমাণ করেছেন। আর সূরা হাশরের ২ নং আয়াত (فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ. الحشر:২) দ্বারা কিয়াসকে শরী‘আতের দলীল প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া হাদীসের কিতাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের কিয়াসের তো বহু বহু প্রমাণ রয়েছে।

আহলে হাদীস সম্প্রদায় ইজমা কিয়াসকে শরী‘আতের দলীল না মানায় তারা সূরা মায়েদার ৩ নং আয়াত اليوم اكملت لكم دينكم. ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম’ অস্বীকারকারী সাব্যস্ত হয়। কেননা এমন হাজার হাজার মাসআলা আছে যার সমাধান সরাসরি কুরআন-হাদীসে পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে ফকীহগণ ইজমা অথবা কিয়াসের মাধ্যমে সমাধান দিয়ে থাকেন। যারা ইজমা ও কিয়াসকে শরী‘আতের দলীল মানবে না তারা ঐসব মাসআলার সমাধান কিভাবে দিবে? এবং আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা ‘আমি আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম’ এর বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব হবে? কয়েকটি মাসআলা লক্ষ্য করুন, আমাদের জানা মতে এগুলোর সমাধান সরাসরি কুরআন-হাদীসে পাওয়া যায় না। আহলে হাদীস সম্প্রদায়কে এই মাসআলাগুলোর সমাধান কোন প্রকার কিয়াসের আশ্রয় নেয়া ছাড়া সরাসরি কুরআনের আয়াত কিংবা সুস্পষ্ট হাদীস দ্বারা দেয়ার অনুরোধ করা হল।

• ডেসটিনি ২০০০ লি. জায়েয হবে কি না?

• প্রাইজবন্ড কেনা জায়েয হবে কি না?

• প্রভিডেন্ড ফান্ড বা জি.পি ফান্ডের টাকা ও লভ্যাংশ গ্রহণ করা জায়েয হবে কি না?

• বর্তমান শেয়ার বাজারে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় জায়েয হবে কি না?

• প্লাস্টিক সার্জারি করা জায়েয হবে কি না?

• বীমা-ইন্স্যুরেন্স করা জায়েয হবে কি না?

• ট্রেড মার্ক বেচা-কেনা জায়েয হবে কি না?

• দেশি-বিদেশি কাগজের নোট পরস্পরে কম-বেশী মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় জায়েয হবে কি না?

• অ্যাডভান্সের টাকা গ্রহণ করা ও ব্যবহার করা জায়েয হবে কি না?

• শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রয় করা বা দান করা জায়েয হবে কি না?

• বিমানে নামায পড়া জায়েয হবে কি না?

• রোযা অবস্থায় ইঞ্জেকশন নেওয়া জায়েয কি না?

হাজার হাজার আধুনিক মাসাইলের মধ্য থেকে মাত্র ১২টি মাসআলা উল্লেখ করা হল। আহলে হাদীস সম্প্রদায় পারলে কোন প্রকার কিয়াসের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া অন্ততঃ এই ১২টি মাসআলার সমাধান যেন কুরআনের স্পষ্ট আয়াত বা স্পষ্ট হাদীস দ্বারা দেন। কুরআনের স্পষ্ট আয়াত বা স্পষ্ট হাদীস দ্বারা এই মাসআলাগুলোর সমাধান না দিতে পারলে তারা ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম’ এই আয়াতের অস্বীকারকারী প্রমাণিত হবে।

তাদেরকে কোন ফিকহী মাসআলার কথা বললে তারা বলে, সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল, মারফূ’ হাদীস দিয়ে দলীল দিলে তারা মানতে রাজি আছে অন্যথায় এসব মাসআলা-মাসাইল তারা মানবে না। তাদেরকে বলব, আপনারা সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল, মারফূ’ হাদীস কাকে বলে অর্থাৎ হাদীসের এসব সংজ্ঞা কুরআনের আয়াত বা হাদীস দ্বারা প্রমাণ করুন তাহলে আমরাও প্রত্যেক মাসআলা সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল, মারফূ’ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করতে পারব। সম্ভব হলে তারা কুরআন কিংবা হাদীস দ্বারা সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল, মারফূ’ হাদীসের সংজ্ঞা প্রমাণ করে দেখাক। অন্ততঃ এতটুকুই প্রমাণ করুক যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল, মারফূ’ হাদীসই মানতে বলেছেন। অন্যান্য হাদীস মানতে নিষেধ করেছেন।

কুরআন-হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে যারা ইমামের ব্যাখ্যা মানে না; বরং সর্বক্ষেত্রে সরাসরি হাদীস মানার দাবী করে থাকে তাদের কাছে সবিনয় আরয, আপনাদের মতানুযায়ী তো মুক্তাদীর ফাতিহা পড়া ছাড়া নামায হবে না। অর্থাৎ মুক্তাদীকে ইমামের পিছনেও সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। এখন প্রশ্ন হল, যদি কোন ব্যক্তি মসজিদে উপস্থিত হয়ে দেখে যে, ইমাম সাহেব কিরা‘আত শেষ করে রুকুতে চলে গেছেন, তখন তার করণীয় কী হবে? অর্থাৎ তার ফাতিহা পড়ার ব্যাপারে আপনাদের মতামত কি? যদি বলেন, সে রুকুতে শরীক হয়ে রুকুতেই ফাতিহা পড়ে নিবে তাহলে সেটা হাদীসের খিলাফ হবে। কেননা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু সিজদার মধ্যে কুরআন পড়তে নিষেধ করেছেন। আর ফাতিহা কুরআনের অংশ হওয়াটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। সুতরাং রুকুতে ফাতিহা পড়া যাবে না। (তিরমিযী, হা. নং ২৬৪)। ইমাম তিরমিযী রহ. এই হাদীসকে হাসানুন সহীহুন বলেছেন। যদি বলেন যে, সে ব্যক্তি এ রাকাআতে শরীক হবে না; বরং দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে তারপর পরবর্তী রাকাআত থেকে ইমামের ইকতিদা করবে। তাহলে এটাও হাদীসের লঙ্ঘন হবে। কারণ, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমামকে যে অবস্থায় পাওয়া যায় সে অবস্থায় তার ইকতিদা করতে বলেছেন। (তিরমিযী, হা. নং ৫৯১)। আলবানী সাহেবও এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা, হা. নং ১১৮৮)। কাজেই নিছক দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। আর যদি বলেন, সে ইমামের সাথে শরীক হবে কিন্তু এই রাকাআতটি গণনা করবে না তাহলে সেটাও হাদীসের খিলাফ হবে। কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকূ পেলে রাকাআত গণনা করতে বলেছেন। (আবূ দাঊদ, হা. নং ৮৯৩। আলবানী সাহেবও হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।) অতএব রুকূ পেলে রাকাআত গণনা না করার উপায় নেই। আর যদি শেষতক বলে বসেন, এ ব্যক্তি ফাতিহা না পড়ে ইমাম যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই তার ইকতিদা করবে। তাহলে এটা স্বয়ং আপনাদের দাবীর খিলাফ হবে। কারণ আপনাদের দাবী ছিল, ফাতিহা পড়া ছাড়া মুক্তাদীর নামাযই হয় না। সুতরাং এই উত্তরেরও অবকাশ নেই। তো আখের যাবেনটা কোথায়?

অনুরূপ কোন ব্যক্তি যদি এমন সময় মসজিদে আসে যখন ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহার শেষাংশ  ولا الضالين  পড়ছেন, তখন তার করণীয় কি হবে? আপনারা যেহেতু হাদীস মানেন তাই হাদীস অনুযায়ী উত্তর দেয়াই সমীচীন হবে। যদি বলা হয়, ইমামের সাথে সেও ‘আমীন’ বলবে। যেমন হাদীসে এসেছে, ইমাম যখন ولا الضالين  বলে তখন তোমরা ‘আমীন’ বল। (সহীহ বুখারী, হা. নং ৭৮২)। তাহলে বলব, তার জন্য তো ফাতিহা পড়া জরুরী। ফাতিহা না পড়লে তো তার নামাযই হবে না। কাজেই ফাতিহা না পড়ে কিভাবে সে ‘আমীন’ বলবে? আর যদি বলা হয়, সে ইমামের   ولا الضالين  বলা সত্ত্বেও ‘আমীন’ বলবে না; বরং আগে ফাতিহা পড়বে তারপর একাকী ‘আমীন’ বলবে। তাহলে বলব, ‘ইমাম যখন ولا الضالين বলে তখন তোমরা ‘আমীন’ বল।’ এই হাদীসের উপর কিভাবে আমল হবে?

আহলে হাদীস ভাইয়েরা কোন হাদীসের সঙ্গে সংঘর্ষ না বাধিয়ে এই প্রশ্নগুলোর গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে পারলে আমরা খুশি হব। আর যদি এগুলোর কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান তাদের জানা না থাকে তাহলে আমরা তাদেরকে ফিকহী মাসাইলের ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাব অনুসরণ করার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। সেক্ষেত্রে তাদের কোন হাদীসেরই বিরোধিতা করতে হবে না। কেননা উল্লেখিত সকল হাদীস বিবেচনায় রেখে হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত হল, ফাতিহা পড়া ছাড়া নামায না হওয়ার হাদীসটি ইমাম ও একাকী নামায আদায়কারীর জন্য প্রযোজ্য। অতএব মুক্তাদী এসে ইমামকে যে অবস্থায় পাবে সে অবস্থায়ই তার সাথে শরীক হয়ে যাবে। তার জন্য ফাতিহা পড়ার প্রয়োজন নেই। অনুরূপ হানাফী মুক্তাদীর জন্য আমীন বলতেও কোন ঝামেলা নেই। কেননা তার জন্যও ফাতিহা পড়ার বিধান নেই। কাজেই সে ইমামের ولا الضالين শোনে ‘আমীন’ বলতে পারবে। আর এতে তাকে কোন হাদীসের বিরোধিতাও করতে হবে না। আল্লাহ তা‘আলা সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং সীরাতে মুস্তাকীমের উপর কায়েম ও দায়েম থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন ॥

Comments

Popular posts from this blog

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ