হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?







প্রথমেই বলে নিতে চাই যে আমার এই কথা ইয়াজিদের পক্ষে উকালতি করার জন্য নয়; বরং মূল সত্যকে বিশ্বের সকল বাংলাভাষী মুসলিমের সামনে তুলে ধরার জন্যে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (র.) বলেন: সকল মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকের ঐকমতে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া হুসাইন (রাঃ) কে হত্যার আদেশ দেন নি। বরং তিনি উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে চিঠির মাধ্যমে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ইরাকের জমিনে হুসাইন (রাঃ) কে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাঁধা দেন। এতটুকুই ছিল তার ভূমিকা। বিশুদ্ধ মতে তার কাছে যখন হুসাইন (রাঃ) নিহত হওয়ার খবর পৌঁছল তখন তিনি আফসোস করেছেন। ইয়াজিদের বাড়িতে কান্নার ছাপ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি হুসাইন (রাঃ) পরিবারের কোন মহিলাকে বন্দী বা দাসীতে পরিণত করেন নি; বরং পরিবারের সকল সদস্যকে সম্মান করেছেন। সসম্মানে হুসাইন (রাঃ) পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। যে সমস্ত রেওয়াতে বলা হয়েছে যে, ইয়াজিদ আহলে বাইতের মহিলাদেরকে অপদস্থ করেছেন এবং তাদেরকে বন্দী করে দামেস্কে নিয়ে বেইজ্জতি করেছেন, তার কোন ভিত্তি নেই। বনী উমাইয়াগণ বনী হাশেমকে খুব সম্মান করতেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যখন ফাতেমা বিনতে আব্দুল্লাহ বিন জাফরকে বিয়ে করলেন তখন আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান এই বিয়ে মেনে নেন নি। তিনি হাজ্জাজকে বিয়ে বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দিয়েছেন।
শুধু তাই নয় হুসাইন (রাঃ) হত্যার জন্য দায়ী উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে যখন হুসাইন (রাঃ) এর পরিবারের মহিলাদেরকে উপস্থিত করা হল তখন তিনি আলাদাভাবে তাদের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করলেন এবং তাদের ভরণ-পোষণ ও পরিধেয় বস্ত্রের ব্যবস্থা করলেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)
ঐতিহাসিক ইজ্জত দাররুযা বলেন: হুসাইন (রাঃ) হত্যার জন্য ইয়াজিদকে সরাসরি দায়ী করার কোন দলীল নেই। তিনি তাঁকে হত্যার আদেশ দেন নি। তিনি যেই আদেশ দিয়েছেন, তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, তাঁকে ঘেরা করা হোক এবং তিনি যতক্ষণ যুদ্ধ না করবেন ততক্ষণ যেন তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করা হয়।
ইমাম ইবনে কাছীর (র.) বলেন: এটি প্রায় নিশ্চিত যে ইয়াজিদ যদি হুসাইন (রাকে জীবিত পেতেন, তাহলে তাঁকে হত্যা করতেন না। তাঁর পিতা হযরত  মুআবীয়া (রাঃ) তাকে এ মর্মে অসীয়তও করেছিলেন। ইয়াজিদ এই কথাটি সুস্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছিলেন।

তাহলে কে হুসাইন (রাঃ) কে হত্যা করল?

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কে হুসাইন (রাঃ) কে হত্যা করল। সুন্নি মুসলিমগণ? আমীর মুআবীয়া? ইয়াজিদ বিন মুআবীয়া? না অন্য কেউ?

উত্তরটি মেনে নেওয়া অনেক মুসলিমের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হলেও তা প্রকাশ না করে পারছি না। প্রকৃত ও সঠিক তথ্য হল শিয়াদের একাধিক কিতাব বলছে যে, শিয়ারাই (ইরাক বাসীরাই) হুসাইন (রাঃ) কে হত্যা করেছে। সায়্যেদ মুহসিন আল-আমীন বলেন: বিশ হাজার ইরাক বাসী হুসাইন (রাঃ) এর পক্ষে বয়াত নেয়। পরবর্তীতে তারা তাঁর সাথে খেয়ানত করেছে, তাঁর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেছে এবং তাঁকে হত্যা করেছে। (দেখুন: আয়ানুশ শিয়া ১/৩৪)

হুসাইন (রাঃ) এর হত্যাকারী নির্ধারণে ইবনে উমর (রাঃ) এর অভিমত:

ইবনে আবী নু'ম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন:
كُنْتُ شَاهِدًا لاِبْنِ عُمَرَ وَسَأَلَهُ رَجُلٌ عَنْ دَمِ الْبَعُوضِ فَقَالَ مِمَّنْ أَنْتَ فَقَالَ مِنْ أَهْلِ الْعِرَاقِ . قَالَ انْظُرُوا إِلَى هَذَا يَسْأَلُنِى عَنْ دَمِ الْبَعُوضِ وَقَدْ قَتَلُوا ابْنَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَسَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ هُمَا رَيْحَانَتَاىَ مِنَ الدُّنْيَا
আমি একদা আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন একজন লোক তাঁকে মশা হত্যা করার হুকুম জানতে চাইল। তিনি তখন লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কোন দেশের লোক? সে বলল: ইরাকের। ইবনে উমর (রা তখন উপস্থিত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: তোমরা এই লোকটির প্রতি লক্ষ্য কর। সে আমাকে মশা হত্যা করার হুকুম জিজ্ঞেস করছে। অথচ তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাতিকে হত্যা করেছে। আর আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, এরা দুজন (হাসান ও হুসাইন (রাঃ) আমার দুনিয়ার দুটি ফুল। (বুখারী, হাদীছ নং- ৫৯৯৪) অন্য বর্ণনায় মশার স্থলে মাছির কথা এসেছে।

হুসাইন (রাঃ) এর ভাষণই প্রমাণ করে যে ইয়াজিদ তাঁর হত্যার জন্য সরাসরি দায়ী নয়:

হুসাইন (রাঃ) নিহত হওয়ার পূর্বে ইরাক বাসীদেরকে ডেকে বলেছেন: তোমরা কি পত্রের মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে আহবান করো নি? আমাকে সাহায্য করার ওয়াদা করো নি? অকল্যাণ হোক তোমাদের! যেই অস্ত্র দিয়ে আমরা ও তোমরা মিলে ইসলামের শত্র“দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এখন সেই অস্ত্র তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে চালাতে যাচ্ছে। মাছি যেমন উড়ে যায় তেমনি তোমরা আমার পক্ষে কৃত বয়াত থেকে সড়ে যাচ্ছ, পোঁকা-মাকড়ের ন্যায় তোমরা উড়ে যাচ্ছ এবং সকল ওয়াদা-অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছ। ধ্বংস হোক এই উম্মতের তাগুতের দলেরা! (দেখুন আল-ইহতেজাজ লিত্ তাবরুসী)
ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর এই ভাষণের কোন স্থানেই তিনি ইয়াজিদকে দায়ী করেন নি। ঘুরেফিরে ভাষণটি এই কথার প্রমাণ করে যে, তাঁর করুন পরিস্থিতির জন্য ইরাক বাসীগণই।
অতঃপর হুর বিন ইয়াজিদ নামক হুসাইন (রাঃ) এর একজন সমর্থক কারবালার প্রান্তরে দাড়িয়ে ইরাক বাসী সৈনিকদেরকে ডাক দিয়ে বললেন: তোমরা কি এই নেককার বান্দাকে এখানে আসতে আহবান করো নি? তিনি যখন তোমাদের কাছে এসেছেন তখন তোমরা তাঁকে পরিত্যাগ করেছ এবং তাঁকে হত্যা করার জন্য তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়েছ। আর তিনি এখন তোমাদের হাতে বন্দী হয়েছেন। আল্লাহ্‌ যেন কিয়ামতের দিন তোমাদের পিপাসা না মেটান এবং তার উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেন! (দেখুন: الإرشاد للمفيد ২৩৪ ، إعلام الورى بأعلام الهدى)
এই পর্যায়ে হুসাইন (রা তাঁর পূর্বের সমর্থকদের বিরুদ্ধে একটি বদদুআ করলেন। তিনি বলেন:
اللهم إن متعتهم إلى حين ففرقهم فرقاً أي شيعاً وأحزاباً واجعلهم طرائق قددا و لا ترض الولاة عنهم أبدا ، فإنهم دعونا لينصرونا ، ثم عدوا علينا فقتلونا (انظر الإرشاد للمفيد ২৪১، إعلام الورى للطبرسي ৯৪৯، كشف الغمة ১৮:২و৩৮
"হে আল্লাহ! আপনি যদি তাদের হায়াত দীর্ঘ করেন, তাহলে তাদের দলের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে দিন। তাদেরকে দলে দলে বিচ্ছিন্ন করে দিন। তাদের শাসকদেরকে তাদের উপর কখনই সন্তুষ্ট করবেন না। তারা আমাদেরকে সাহায্য করবে বলে ডেকে এনেছে। অতঃপর আমাদেরকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হয়েছে।
হুসাইন (রাঃ) এর এই দুয়া প্রমাণ করে যে, ইয়াজিদ প্রত্যক্ষভাবে হুসাইন (রাঃ) এর হত্যায় জড়িত ছিল না। কেননা তিনি দুয়ায় বলেছেন: হে আল্লাহ! আপনি তাদের শাসকদেরকে তাদের উপর কখনই সন্তুষ্ট করবেন না। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ইরাক বাসীগণ (শিয়াগণ) উমাইয়া শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় হুসাইন (রাঃ) এর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে এবং তাঁর সাথে খেয়ানত করেছে। বাস্তবে তাই হয়েছে। পরবর্তীতে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকেও নির্মম ও নিকিৃষ্টভাবে হত্যা করা হয়েছে।

আলী বিন হুসাইন (রাঃ) তাঁর পিতা হুসাইন (রাকে হত্যার জন্য কুফা বাসীদেরকে দায়ী করেছেন?

শিয়া ঐতিহাসিক ইয়াকুবী বলেন: আলী বিন হুসাইন (রাঃ) যখন কুফায় প্রবেশ করলেন তখন দেখলেন কুফার মহিলারা হুসাইন (রাঃ) হত্যার বেদনায় ক্রন্দন এবং বিলাপ করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ এরা কি আমাদের হত্যায় বিলাপ করছে? তাহলে আমাদেরকে হত্যা করল কে? অর্থাৎ তারা ব্যতীত আমাদের পরিবারের লোক ও আত্মীয়দেরকে অন্য কেউ হত্যা করে নি (দেখুন: তারিখে ইয়াকুবে ১/২৩৫)
উপরে বর্ণিত পৃষ্ঠা নাম্বারসহ তাদের কিতাবগুলোর তথ্য প্রমাণ করে যে, যারা নিজেদরোকে হুসাইন (রাঃ) এর সমর্থক ও প্রেমিক বলে দাবী করেন, তারাই তাঁকে হত্যা করেছেন। অতঃপর এই মারাত্মক অপরাধের জ্বালা অন্তর থেকে দূর করার জন্য তারাই পরবর্তীতে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন এবং যাদের কান্না আসে নি, তারাও অযথা কান্নার ভান করেছেন। এই খেলা-তামাশা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং এখনও চলছে। তাদের অনুসারীরা এখনও হুসাইন (রাঃ) এর জানাজা বহন করছেন।হুসাইন (রাঃ) এর মৃত্যুতে রোদন করা যদি আহলে বাইতের প্রতি তাদের প্রকৃত ভালবাসার প্রমাণ হয়, তাহলে হুসাইন (রাঃ) এর প্রতি তাদের ভালবাসা সত্য হলে তারা হামজাহ (রাএর মৃত্যুতে রোদন করে না কেন?
হুসাইন (রাঃ) এর উপর তাদের এই কান্না যদি আহলে বাইতের প্রতি অগাধ ভালবাসার কারণেই হত, তাহলে শহীদদের সরদার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হামজা (রাঃ) এর মৃত্যুতে তারা ক্রন্দন করে না কেন? তাঁকে যে নির্মমভাবে ও পাশবিকতার হত্যা করা হয়েছে, হুসাইন (রাঃ) হত্যার পাশবিকতার চেয়ে তা কোন অংশে কম নয়। সায়্যেদ হামজাকে হত্যা করে তাঁর পেট ফেরে কলিজা বের করা হয়েছে। তারা কেন এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বাৎসরিক মাতম করে না? তাদের বুক ও চেহারায় আঘাত করে না কেন? কাপড় টেনে ছিঁড়ে না কেন? প্রতি বছর যখন উহুদ যুদ্ধের দিন ও তারিখ আসে তখন তলোয়ার খেলায় মেতে উঠে না কেন? সায়্যেদ হামজাহ কি আহলে বাইতের একজন সম্মানিত সদস্য নন? এখানেই শেষ নয়; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর চেয়ে অধিক বড় কোন মুসীবত আছে কি? তাঁর মৃত্যুতে তাদের ক্রন্দন ও মাতম কোথায়? সচেতন পাঠকদেরকেই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে নিতে হবে এবং কারও আকীদায় ত্রুটি থাকলে লেখাটি পড়েই তা সংশোধন করে নিতে হবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের কাছে হুসাইন (রাঃ);ই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কি কারণে তাদের কাছে এত প্রিয়? উত্তর পূর্বে উল্লেখ করেছি। সেটিই আসল কারণ? না ইমাম হুসাইন (রাঃ) কর্তৃক একজন পারস্য মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, তাই এত ভালবাসা? উভয়টিই এর কারণ হতে মানা কোথায়? হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর পিতা আলী বিন আবু তালিব সম্পর্কে তাদের অন্যান্য আকীদাহ-বিশ্বাসের দিকে না গিয়ে এখানেই ছেড়ে দিলাম।

হুসাইন (রাঃ) এর মাথা কোথায় গিয়েছিল?

দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে হুসাইন (রাঃ) এর মাথা প্রেরণের বর্ণনা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয় নি। বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, তিনি কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন। তাঁর সম্মানিত মাথা কুফার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেন: হুসাইন (রাঃ) এর মাথা উবাইদুল্লাহ এর কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তাঁর মাথাকে একটি থালার মধ্যে রেখে একটি কাঠি হাতে নিয়ে তা নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন এবং তাঁর সৌন্দর্য দেখে সম্ভবত বেখেয়ালে কিছুটা বর্ণনাও করে ফেলেছিলেন। হাদীছের শেষের দিকে আনাস (রাঃ) বলেন: হুসাইন (রাঃ) ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ। (বুখারী)
অন্য বর্ণনায় আছে, আনাস (রাঃ) বলেন: আমি উবাইদুল্লাহকে বললাম, তোমার হাতের কাঠি হুসাইন (রঃ)এর মাথা থেকে উঠিয়ে ফেল। কারণ আমি তোমার কাঠি রাখার স্থানে রাসূলের পবিত্র মুখ দিয়ে চুমু খেতে দেখেছি। এতে কাঠি সংকোচিত হয়ে গেল। (দেখুন: ফতহুল বারী ৭/৯৬)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এরপর কোথায় হুসাইন (রাঃ) এর কবর হয়েছে এবং তাঁর মাথা কোথায় গিয়েছে, তা সঠিক সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় নি। প্রকৃত ও সঠিক জ্ঞান আল্লাহর নিকটেই।

যেমন কর্ম তেমন ফল:

পরবর্তীতে আল-আশতার নাখয়ীর হাতে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ নির্মমভাবে নিহত হন। যখন নিহত হলেন তখন তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মসজিদে রাখা হল। তখন দেখা গেল একটি সাপ এসে মাথার চারপাশে ঘুরছে। পরিশেষে উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বের হল। ফের মুখ দিয়ে প্রবেশ করে নাকের ছিদ্র দিয়ে তিনবার বের হতে দেখা গেল। (দেখুন: তিরমিযী, ইয়াকুব বিন সুফীয়ান)

ইয়াজিদ সম্পর্কে একজন মুসলিমের ধারণা কেমন হওয়া উচিত:

তাফসীর, হাদীছ, আকীদা, এবং ইতিহাস ও জীবনীর কিতাবগুলো অধ্যয়ন করে যতদূর জানতে পেরেছি, তাতে দেখা যায় সালফে সালেহীনের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং অনুকরণীয় কোন ইমামের কিতাবে ইয়াজিদের উপর লানত করা বৈধ হওয়ার কথা আজ পর্যন্ত খুঁজে পাই নি। কেউ তার নামের শেষে রাহিমাহুল্লাহ বা লাআনা হুল্লাহ- এ দু’টি বাক্যের কোনটিই উল্লেখ করেন নি। সুতরাং তিনি যেহেতু তার আমল নিয়ে চলে গেছেন, তাই তার ব্যাপারে আমাদের জবান দরাজ করা ঠিক নয়। তাকে গালাগালি করাতে আমাদের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু অর্জিত হবে না। তার আমল নিয়ে তিনি চলে গেছেন। আমাদের আমলের হিসাব আমাদেরকেই দিতে হবে। তার ভাল মন্দ আমলের হিসাব তিনিই দিবেন।
ইমাম যাহাবী ইয়াজিদের ব্যাপারে বলেন:
لانسبه ولانحبه
অর্থাৎ "আমরা তাকে গালি দিবো না এবং ভালও বাসবো না।" মদ পান করা, বানর নিয়ে খেলা করা, ফাহেশা কাজ করা এবং আরও যে সমস্ত পাপ কাজের অপবাদ ইয়াজিদের প্রতি দেয়া হয়, তা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তবে তাঁর চেয়ে হুসাইন (রাঃ) যে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সুতরাং তিনি মুসলিম ছিলেন। তার জীবনের শেষ মুহূর্তে আমরা যেহেতু উপস্থিত ছিলাম না, তাই তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াই অধিক নিরাপদ। তা ছাড়া বুখারী শরীফের একটি হাদীছে তার ক্ষমা পাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেখানে আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমার উম্মতের একটি দল কুস্তুনতীনিয়ায় যুদ্ধ করবে। তাদেরকে ক্ষমা করা দেয়া হবে। জানা যাচ্ছে, ইয়াজিদ বিন মুআভীয়া ছিলেন সেই যুদ্ধের সেনাপতি। আর হুসাইন (রাঃ) তাতে সাধারণ সৈনিক হিসেবে শরীক ছিলেন। সুতরাং ইয়াজিদও ক্ষমায় শামিল হতে পারে। আল্লাহই ভাল জানেন।

এজিদের ব্যপারে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের দৃষ্টিভঙ্গিঃ

একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, হযরত হুসাইন রাঃ উপর জুলুম হয়েছে। তাকে অন্যায়ভাবে শহীদ করা হয়েছে। তিনি হকের উপর ছিলেন। মাজলুম ছিলেন।

কিন্তু এর জন্য এজিদ কতটুকু দায়ী? এ বিষয়টি যেহেতু কুরআন ও হাদীস দ্বারা নয়, বরং ইতিহাসের উপর নির্ভরশীল। আর এ বিষয়ক অধিকাংশ ইতিহাসই শিয়াদের দ্বারা লিখিত। আর ইতিহাসে সত্য মিথ্যার মারাত্মক মিশ্রণ রয়েছে। তাই এজিদের অবস্থান নিয়ে সরাসরি কিছু না বলাই উচিত। চুপ থাকাই সবচে’ নিরাপদ। অমুসলিম বলাতো কিছুতেই বৈধ হবে না। কারণ কাফের হবার কোন সত্যিকার কারণ তার থেকে সঠিক ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই একজন মুসলমানকে কাফির বলা কিছুতেই জায়েজ হবে না।

এ কারণে এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকাকেই আমরা নিরাপদ মনে করি। তিনি তার আমল নিয়ে কবরে চলে গেছেন। হাশরের ময়দানেই বিচার হবে হক ও বাতিলের। আমরা অযথা এ বিষয়ে মুখ খুলে নিজেকে বিপদগ্রস্থ করার কোন মানে হয় না।

আর এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় ৩টি বই পড়তে পারেন-

১- মাওলানা মইনুদ্দীন খান অনূদিত “জীবন সায়াহ্নে মানবতার রূপ”।

২-মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহঃ রচিত “কারবালার ইতিহাস”।

৩- মুফতী মানসুরুল হক রচিত “ইসলামী খিলাফত ধ্বংসের প্রকৃত ইতিহাস”।

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের নিকট এজিদের উপর লানত বর্ষণ করা জায়েজ নয়। তার উপর লানত বর্ষণ করা রাফেজীদের প্রতীক। তার ব্যাপারে আমাদের মন্তব্য হল, তার মাঝে ভালমন্দের মিশ্রণ ছিল। তাই আমরা তার ব্যাপারে ভাল বা মন্দ কোনটিই বলি না।

বাকি সত্যিই যদি তিনি হযরত হুসাইন রাঃ এর হত্যার নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি চরম পাপিষ্ঠ। এতে কোন সন্দেহ নেই।

কিন্তু বিষয়টি যেহেতু ইতিহাস নির্ভর। আর ইতিহাস সত্যমিথ্যার মিশ্রণে ভরপুর। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া দুষ্কর।

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকীদার উপর রচিত কবিতায় এসেছেঃ

ولم يلعن يزيدا بعد موت

سوى المكثار فى الأغراء غال

এজিদের মৃত্যুর পর প্রগলভ সীমালঙ্ঘণকারী কতিপয় উস্কানীদাতা ছাড়া তার উপর কেউ লানত বর্ষণ করেনি।

উক্ত কবিতায় ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহঃ লিখেছেনঃ

لم يلعن أحد من السلف يزيد بن معاوية سوى الذين اكثر والقول فى التحريض على لعنه وبالغوا فى أمره وتجاوزوا عن حده كالرافضية والخوارج وبعض المعتزلة… فلا شك ان السكوت أسلم (شرح الأمالى لملا على القارى-27-28)

এজিদের উপর সালাফের কেউ লানত বর্ষণ করেননি। রাফেজী, খারেজী এবং কতিপয় মুতাজিলা ছাড়া। যারা বাচালতার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘণকারী।

মোল্লা আলী কারী রহঃ এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা পর লিখেছেনঃ

فلا شك ان السكوت اسلم

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তার ব্যাপারে চুপ থাকাই নিরাপদ। [শরহুল আমালী, মোল্লা আলী কারীকৃত-২৭-২৮]

এ কারণেই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকীদা হল, এজিদের উপর লানতও বর্ষণ করা হবে না। আবার হযরত হুসাইন রাঃ এর বিপরীতে তার প্রশংসাও করা হবে না। [আপ কি মাসায়েল আওর উনকা হল-১/৪০২-৪০৩]

আল্লাহ তাআ'লা আমাদেন সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন

Comments

  1. কি মগজ দোলাই দিয়েছে আপনাদের? যাদার বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছেন, এরা মুয়াবিয়া বাহিনি। ইয়াযিদের সময় ৩টি ঘটনা ঘটে কারবালার হত্যা, মদিনায় আক্রমন ও মহিলাদের নির্যাতন ও মক্কায় আক্রমন করে কাবায় অগ্নি সংযোগ করা, ইবনে যুবায়ের রাঃ দেহকে খন্ডবিখন্ড করা। তদের মত মুসলিম ইমাম রাই আহলে বায়তদের হত্যায় যুগে যুগে উৎসাহ যুগিয়েছে। আর হাদিসের দোহাই দিয়ে বলছেন ,সে জান্নাতি। আরে গাদা তর কোন সহি আকিদা আছে? হাদিস বুঝার। ধর একবার কলিমা পরলে সে মাফ পেয়ে যাবে, হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু কলিমা পরে কেউ যদি মানুষ হত্যা কোঁড়ে তখন কি এই হাদিস ঠিকবে গাদা

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ