বিতর নামাজ তিন রাকা'আত পর্ব-১







প্রত্যেক প্রাপ্ত-বয়স্ক ও সুস্থ-মস্তিষ্কসম্পন্ন মুসলমান পুরুষ ও মহিলার উপর ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব ও ইশার নামায আদায় করা ফরযে ‘আইন এবং বিতরের নামায আদায় করা ওয়াজিব। কোনো কারণে সময়মতো আদায় করতে না পারলে এসব নামায কাযা করে নেয়া আবশ্যক। বিতর নামায আদায় করার নির্ধারিত সময় হলো: ইশার ফরজ ও সুন্নাত আদায়ের পর থেকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।

বিতর নামায দুই বৈঠকে এক সালামে তিন রাকা‘আত পড়তে হয়। এটাই নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমল, সাহাবায়ে কিরামের আমল, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ ও তৎপরবর্তী মুসলিম উম্মাহর ধারাবাহিক আমল।
বিস্তারিত আলোচনা নিম্নের শিরোনামগুলোর অধীনে পেশ করা হচ্ছে:

১. বিতর নামায তিন রাকা‘আত। 

ক. নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমল।

খ. সাহাবায়ে কিরামের আমল।

গ. তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈগণের আমল।

২. এক সালামে তিন রাকা‘আত বিতর ও দ্বিতীয় রাকা‘আতে শুধু তাশাহহুদ।

৩. তৃতীয় রাকা‘আতে রুকূর আগে দু‘আয়ে কুনূত।

৪. দু‘আয়ে কুনূতের আগে তাকবীর দিয়ে হাত উঠানো এবং পুনরায় হাত বাঁধা।

৫. দু‘আয়ে কুনূত কী?

৬. এক রাকা‘আত বিতরের দলীলসমূহ ও সেগুলোর পর্যালোচনা।

বিতর নামায তিন রাকা‘আত:

ক. নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল: নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। অসংখ্য হাদীস দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। নিম্নে এ বিষয়ে কিছু হাদীস পেশ করা হলো:

(১) ‘আবূ সালামা রহ. বলেন, আমি হযরত আয়িশা রা.কে জিজ্ঞাসা করলাম:

كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ؟ فَقَالَتْ: «مَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ وَلاَ فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلاَثًا»

অর্থ: রামাযানে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামায কেমন ছিলো? হযরত আয়িশা রা. বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানে ও রামাযানের বাহিরে এগারো রাকা‘আতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকা‘আত পড়তেন, এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না। এরপর আরো চার রাকা‘আত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না। এরপর তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। (সহীহ বুখারী হা. নং ১১৪৭, সহীহ মুসলিম: ৭৩৮)

এ হাদীসের বিশ্লেষণে ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন, তিনি চার রাকা‘আত পড়ে ঘুমাতেন। তারপর আবারো চার রাকা‘আত পড়ে ঘুমাতেন। অতঃপর উঠে তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। (আল ইস্তিযকার: ২/১০০)

(২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী কয়েস রহ. বলেন, আমি হযরত আয়িশা রা.কে বললাম:

بِكَمْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُوتِرُ؟ قَالَتْ: «كَانَ يُوتِرُ بِأَرْبَعٍ وَثَلَاثٍ، وَسِتٍّ وَثَلَاثٍ، وَثَمَانٍ وَثَلَاثٍ، وَعَشْرٍ وَثَلَاثٍ، وَلَمْ يَكُنْ يُوتِرُ بِأَنْقَصَ مِنْ سَبْعٍ، وَلَا بِأَكْثَرَ مِنْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ».

অর্থ: নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতো রাকা‘আত বিতর পড়তেন? তিনি উত্তরে বললেন, চার (তাহাজ্জুদ) ও তিন (বিতর), ছয় (তাহাজ্জুদ) ও তিন (বিতর), আট (তাহাজ্জুদ) ও তিন (বিতর), দশ (৮ তাহাজ্জুদ ও ২ ফজরের সুন্নাত) ও তিন (বিতর) । তিনি বিতর সাত রাকা‘আতের কম ও তেরো রাকা‘আতের অধিক পড়তেন না। (সুনানে আবূ দাউদ: ১/১৯৩, হা. নং ১৩৬২, শারহু মাআনিল আসার: ১/২০১, মুসনাদে আহমাদ: ৬/১৪৯, হা. নং ২৫১৫৯)

আল্লামা ‘আইনী ও শুয়াইব আরনাউত এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রহ. বলেন, এ ধরণের হাদীসগুলোতে বিতরসহ রাতের পুরো নামাযকেই বিতর শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। (সুনানে তিরমিযীর ৪৫৭ নং হাদীস-পরবর্তী বক্তব্য দ্রষ্টব্য।) হাফেজ ইবনে হাজার রহ. উপরোল্লিখিত হাদীসটি সম্পর্কে বলেন, আমার জানা মতে এটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সর্বাধিক সহীহ হাদীস। বিতর বিষয়ে হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসের বর্ণনাকারীদের মাঝে যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, এ হাদীস দ্বারা সেসবের মাঝে সমন্বয় করা যায়। (ফাতহুল বারী: ৩/২৫)

আর এ হাদীসে সর্বাবস্থায় তিন রাকা‘আত পৃথকভাবে পড়ার কথা উল্লেখ আছে। সুতরাং স্পষ্ট বোঝা যায়, এটিই প্রকৃত বিতর।

(৩) সা’দ ইবনে হিশাম হযরত আয়িশা রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন:

"أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا صَلَّى الْعِشَاءَ دَخَلَ الْمَنْزِلَ، ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ صَلَّى بَعْدَهُمَا رَكْعَتَيْنِ أَطْوَلَ مِنْهُمَا، ثُمَّ أَوْتَرَ بِثَلَاثٍ لَا يَفْصِلُ فِيهِنَّ."

অর্থ: ইশার নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে প্রবেশ করে দুই রাকা‘আত নামায পড়তেন। অতঃপর আরো দুই রাকা‘আত পড়তেন, যা পূর্বাপেক্ষা দীর্ঘ হতো। তারপর তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন, তাতে মাঝে (দুই রাকা‘আত শেষে) সালাম ফিরাতেন না। (মুসনাদে আহমদ হা. নং ২৫২২৩, এর সনদ হাসান)

(৪) হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন:

«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ ثَمَانَ رَكَعَاتٍ، وَيُوتِرُ بِثَلَاثٍ، وَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ صَلَاةِ الْفَجْرِ»

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে আট রাকা‘আত নামায পড়তেন, অতঃপর তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন এবং ফজরের নামাযের পূর্বে আরো দুই রাকা‘আত নামায আদায় করতেন। (সুনানে নাসাঈ: ১/২৪৯, হা. নং ১৭০৭, তহাবী: ১/২০২, আল্লামা ‘আইনী রহ. বলেন, এটি সহীহ মুসলিমের মানোত্তীর্ণ। নুখাবুল আফকার : ৩/২৫১)

(৫) হযরত শা’বী রহ. বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.কে জিজ্ঞাসা করেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রাতের নামায কতো রাকা‘আত ছিলো?

سَأَلْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ وَابْنَ عُمَرَ: كَيْفَ كَانَ صَلَاةُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِاللَّيْلِ؟ قَالَا: «ثَلَاثَ عَشْرَةَ رَكْعَةً، وَيُوتِرُ بِثَلَاثٍ، وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْفَجْرِ»

অর্থ: তারা উভয়ে বলেন, (তিনি রাতে) মোট তেরো রাকা‘আত (নামায পড়তেন), প্রথমে আট রাকা‘আত, অতঃপর তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। আর ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে দুই রাকা‘আত (ফজরের সুন্নাত) আদায় করতেন। (সুনানে নাসাঈ কুবরা হা. নং ৪০৮, ১৩৫৭, সুনানে ইবনে মাজাহ হা. নং ১৩৬১, তহাবী: ১/১৯৭, আল্লামা ‘আইনী বলেন, এর সনদ সহীহ। নুখাবুল আফকার: ৩/২১১)

(৬) আলী ইবনে আব্দুল্লাহ রহ. তার পিতা ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন:

عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ «قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَاسْتَنَّ، ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ نَامَ، ثُمَّ قَامَ فَاسْتَنَّ، ثُمَّ تَوَضَّأَ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ حَتَّى صَلَّى سِتًّا، ثُمَّ أَوْتَرَ بِثَلَاثٍ، وَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ»

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে শয্যা থেকে উঠলেন, এরপর মিসওয়াক করে উযু করলেন এবং দুই রাকা‘আত নামায পড়লেন। এভাবে দুই দুই করে ছয় রাকা‘আত নামায পড়লেন। অতঃপর তিন রাকা‘আত বিতর পড়লেন। সবশেষে আরো দুই রাকা‘আত নামায পড়লেন। (সুনানে নাসাঈ: ১/২৪৯, হা. নং ১৭০৪, মুসনাদে আহমাদ: ১/৩৫০, হা. নং ৩২৭১, তহাবী: ১/২০১, ২০২। শুয়াইব আরনাউত বলেন, এর সনদ মজবুত ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী রয়েছে।)

সহীহ মুসলিম শরীফের বর্ণনায় রয়েছে:

...ثُمَّ قَامَ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ، فَأَطَالَ فِيهِمَا الْقِيَامَ وَالرُّكُوعَ وَالسُّجُودَ، ثُمَّ انْصَرَفَ فَنَامَ حَتَّى نَفَخَ، ثُمَّ فَعَلَ ذَلِكَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ سِتَّ رَكَعَاتٍ، كُلَّ ذَلِكَ يَسْتَاكُ وَيَتَوَضَّأُ وَيَقْرَأُ هَؤُلَاءِ الْآيَاتِ، ثُمَّ أَوْتَرَ بِثَلَاثٍ.

অর্থ: ...অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে তিনবারে ছয় রাকা‘আত নামায আদায় করলেন। প্রতিবারেই মিসওয়াক ও উযু করেছেন এবং উপরিউক্ত আয়াতগুলো পড়েছেন, সব শেষে তিন রাকা‘আত বিতর পড়েছেন। (সহীহ মুসলিম: ১/২৬১, হা. নং ৭৬৩, সহীহ আবূ আওয়ানা: ২/৩২১)

সা’দ ইবনে হিশাম রহ. হযরত ইবনে আব্বাস রা.কে বিতর নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে হযরত আয়িশা রা.-এর কাছে পাঠান আর বলে দেন, তিনি কী বলেন আমাকেও জানাবে। অতঃপর সা’দ ইবনে হিশাম ফিরে এসে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরলে হযরত ইবনে আব্বাস রা. বললেন, তুমি সত্য বলেছো। সুযোগ থাকলে আমিই সরাসরি হযরত আয়িশা রা.-এর কাছ থেকে শুনে আসতাম। (সহীহ মুসলিম হা. নং ৭৪৬)

এতে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর তাহাজ্জুদ-এর রাকা‘আত সংখ্যা ৪ ও ৮ হলেও বিতর নামাযের বিবরণে হযরত আয়িশা রা. ও ইবনে আব্বাস রা. উভয়ে একমত। হযরত আয়িশা রা.-এর বর্ণনায় যে অস্পষ্টতা রয়েছে তা ইবনে আব্বাস রা.-এর বর্ণনায় স্পষ্ট হয়ে গেলো। অর্থাৎ, এগারো রাকা‘আত নামাযের শেষ তিন রাকা‘আত হলো বিতর এবং হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত সা’দ ইবনে হিশামের হাদীসে ষষ্ঠ রাকা‘আতে বসা কিন্তু সালাম না ফিরিয়ে উঠে পড়া মূলত তিন রাকা‘আত বিতরের দ্বিতীয় রাকা‘আত।

(৭) হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আবযা রা. বর্ণনা করেন:

أَنَّهُ صَلَّى مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْوِتْرَ فَقَرَأَ فِي الْأُولَى: بِ سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى وَفِي الثَّانِيَةِ قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ وَفِي الثَّالِثَةِ قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ فَلَمَّا فَرَغَ قَالَ: «سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ ثَلَاثًا , يَمُدُّ صَوْتَهُ بِالثَّالِثَةِ»

অর্থ: একবার তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে বিতর পড়লেন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম রাকা‘আতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকা‘আতে সূরা কাফিরূন আর তৃতীয় রাকা‘আতে সূরা ইখলাস পড়লেন। (তহাবী: ১/২০৫, আল্লামা ‘আইনী বলেন, এর সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য, নুখাবুল আফকার : ৩/২৭১, মুসনাদে আবী হানীফা- জামিউল মাসানীদ : ১/৪১৪, সুনানে নাসাঈ হা. নং ১৭৩৩, শুয়াইব আরনাউত ও মুহাম্মাদ আওয়ামা এ হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. আত-তালখীসুল হাবীরে বলেন, إسناده حسن এর সনদ হাসান)

(৮) সাঈদ ইবনে যুবায়ের রা. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন:

«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُوتِرُ بِثَلَاثٍ، يَقْرَأُ فِي الْأُولَى بِسَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى، وَفِي الثَّانِيَةِ بِقُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ، وَفِي الثَّالِثَةِ بِقُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ»

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। প্রথম রাকা‘আতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকা‘আতে সূরা কাফিরূন আর তৃতীয় রাকা‘আতে সূরা ইখলাস পড়তেন। (সুনানে নাসাঈ: ১/২৪৯, হা. নং ১৭০৭, সুনানে তিরমিযী হা. নং ৪৬২, সুনানে দারিমী হা. নং ১৫৮৯, ইবনে আবী শাইবাহ: ৪/৫১২, হা. নং ৬৯৫১, মুসনাদে আহমাদ হা. নং ২৭৭৬। শুয়াইব আরনাউত বলেন, হাদীসটি সহীহ। ইমাম নববীও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)

(৯) হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. বলেন:

أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُوتِرُ بِثَلَاثِ رَكَعَاتٍ، كَانَ يَقْرَأُ فِي الْأُولَى بِسَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى، وَفِي الثَّانِيَةِ بِقُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ، وَفِي الثَّالِثَةِ بِقُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ، وَيَقْنُتُ قَبْلَ الرُّكُوعِ، فَإِذَا فَرَغَ، قَالَ عِنْدَ فَرَاغِهِ: «سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ»، ثَلَاثَ مَرَّاتٍ يُطِيلُ فِي آخِرِهِنَّ
وفي رواية : وَلَا يُسَلِّمُ إِلَّا فِي آخِرِهِنَّ، وَيَقُولُ ـ يَعْنِي بَعْدَ التَّسْلِيمِ ـ: «سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ»، ثَلَاثًا.

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। প্রথম রাকা‘আতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকা‘আতে সূরা কাফিরূন, তৃতীয় রাকা‘আতে সুরা ইখলাস পড়তেন এবং রুকূর পূর্বে দু‘আয়ে কুনূত পড়তেন। একই হাদীসের অপর বর্ণনায় আছে, “আর কেবল শেষ রাকা‘আতেই সালাম ফিরাতেন”। (সুনানে নাসাঈ : ১/১৯১, হা. নং ১৬৯৯, মুশকিলুল আসার : ১১/৩৬৮; আল্লামা ‘আইনী, ইবনুল কাত্তান, শাইখ শুয়াইব আরনাউত প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। স্বয়ং আলবানী সাহেবও ইরওয়াউল গালীল : ২/১৬৭-এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)

(১০) হযরত আয়িশা রা. বলেন:

كَانَ يَقْرَأُ فِي الأُولَى: بِ {سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى}، وَفِي الثَّانِيَةِ بِ {قُلْ يَا أَيُّهَا الكَافِرُونَ}، وَفِي الثَّالِثَةِ بِ {قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ}، 

অর্থ: নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতরের প্রথম রাকা‘আতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকা‘আতে সূরা কাফিরূন আর তৃতীয় রাকা‘আতে সূরা ইখলাস পড়তেন। (তিরমিযী হা. নং ৪৬৩)

শেষের চারটি হাদীসে এ বিষয়ে কোনোরূপ অস্পষ্টতা নেই যে, নবীজী তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। রাকা‘আতগুলোর বিবরণে স্পষ্টই উল্লেখ আছে- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়। এছাড়া, অধিকাংশ সাহাবা ও তাবেঈগণ এভাবেই তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। এ বিষয়ে ইমাম তিরমিযী রহ. তার সুনানে তিরমিযীতে সু¯পষ্টভাবে বলেন:

وَالَّذِي اخْتَارَهُ أَكْثَرُ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ أَنْ يَقْرَأَ: بِ {سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى}، وَ {قُلْ يَا أَيُّهَا الكَافِرُونَ}، وَ {قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ}، يَقْرَأُ فِي كُلِّ رَكْعَةٍ مِنْ ذَلِكَ بِسُورَةٍ.

অর্থ: সাহাবায়ে কিরাম ও তৎপরবর্তী অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম (বিতরে) সূরা আ’লা, কাফিরূন ও ইখলাস পড়াকেই গ্রহণ করেছেন। (তিন রাকা‘আতের) প্রতি রাকা‘আতে একটি করে সূরা পড়বে। (সুনানে তিরমিযী ‘বিতরে ক্বিরা‘আত পাঠ’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।)

এভাবে উনিশজন সাহাবী থেকে তিন রাকা‘আত বিতরে তিন সূরা পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। (কাশফুস সিতর: পৃ. ৪৭, আল হিদায়া ফী তাখরীজি আহাদিসিল বিদায়া: ৪/১৪৮)

আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা রহ. বলেন:

فإنه قد ثبت أن أبي بن كعب ركعة كان يقو بالناس عشرين في يرمضانو يوتر بثلاث، فرأى كثير من العلماء أن ذلك السنة لأنه أقامه بين المهاجرين و الأنصار ولم ينكره منكر .

অর্থ: বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত যে, হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. তার ইমামতিতে লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকা‘আত তারাবীহ, অতঃপর তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। অনেক উলামায়ে কিরাম মনে করেন, তারাবীহর এটিই প্রকৃত সুন্নাত। কারণ তিনি অনেক মুহাজির ও আনসারী সাহাবীর সামনে এ নামায পড়েছেন। তাদের কেউই এ আমলের বিরোধিতা করেননি, বা একে ভুল আখ্যা দেননি। (আল ফাতওয়াল কুবরা: ২/২৪৫) 

খ. সাহাবায়ে কিরামের আমল:

(১) হযরত উমর রা. বলেন:

«مَا أُحِبُّ أَنِّي تَرَكْتُ الْوِتْرَ بِثَلَاثٍ، وَإِنَّ لِي حُمْرَ النَّعَمِ»

অর্থ: আমি তিন রাকা‘আত বিতর পড়া ছাড়তে কখনোই পছন্দ করি না, যদিও এর বিনিময়ে আমাকে লাল উট উপহার দেয়া হয়। (কিতাবুল আসার, জামিউল মাসানীদ: ১/৪১৭, মুয়াত্তায়ে মুহাম্মাদ: পৃ. ১৪৯, কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ: ১/১৩৫)

(২) হযরত যাযান রহ. বলেন:

َنَّ عَلِيًّا كَانَ يُوتِرُ بِثَلَاثٍ

অর্থ: হযরত আলী রা. তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবাহ: ৪/৪৯১, হা. নং ৬৯১৪, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৩/৩৪, হা. নং ৪৬৯৯)

(৩) হযরত আব্দুল মালেক ইবনে উমায়ের রহ. বলেন:

كَانَ ابْنُ مَسْعُوْدٍ يُوْتِرُ بِثَلَاثٍ

অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবাহ: ৪/৪৯১, হা. নং ৬৮৯৪)

(৪) হযরত সাঈদ ইবনে ইয়াযীদ রহ. বলেন:

أن أبي بن كعب يُوْتِرُ بِثَلَاثٍ

অর্থ: হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৩/২৬, হা. নং ৪৬৬১)

(৫) হযরত হুমাইদ রহ. বলেন:

عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ : الوِتْرُ ثَلَاثُ رَكَعَاتٍ وَ كَانَ يُوْتِرُ بِثَلَاثِ رَكَعَاتٍ

অর্থ: হযরত আনাস রা. বলেছেন, বিতর তিন রাকা‘আত এবং তিনি নিজেও তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবাহ: ৪/৪৯১, হা. নং ৬৮৯৩, তহাবী: ১/২০২, সালাতুল বিতর লিল মারওয়াযী: পৃ. ২৬৪)

(৬) আবূ গালিব রহ. বলেন:

 كَانَ أَبُوْ أُمَامَةَ يُوْتِرُ بِثَلَاثِ رَكَعَاتٍ

অর্থ: হযরত আবূ উমামা রা. তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবাহ: ৪/৪৯১, হা. নং ৬৮৯৬, তহাবী: ১/২০২)

গ. তাবেঈগণের আমল:

(১) হযরত ইসমাঈল ইবনে আব্দুল মালেক রহ. বলেন:

عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، «أَنَّهُ كَانَ يُوتِرُ بِثَلَاثٍ، وَيَقْنُتُ فِي الْوَتْرِ قَبْلَ الرُّكُوعِ

অর্থ: হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ. তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন এবং বিতর নামাযে রুকূর পূর্বে দু‘আয়ে কুনূত পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবাহ: ৪/৪৯৩, হা. নং ৬৯০৫)

عَنْ مَكْحُوْلٍ أَنَّهُ كَانَ يُوْتِرُ بِثَلَاثٍ لَا يُسَلِّمُ إِلَّا فِيْ آخِرِهِنَّ.

অর্থ: হযরত মাকহুল রহ. তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন এবং তিন রাকা‘আত শেষে সালাম ফিরাতেন। (ইবনে আবী শাইবাহ: ৪/৪৯৩, হা. নং ৬৯০৬)

এছাড়াও হযরত আলক্বমা, ইবরাহীম নাখয়ী, জাবের ইবনে যায়েদ, হাসান, ইবনে সিরীন, ক্বাতাদাহ, বাকর ইবনে আব্দুল্লাহ আলমুযানী, মু‘আবিয়া ইবনে কুররাহ, ইয়াজ ইবনে মু‘আবিয়া রহ. প্রমুখ থেকেও তিন রাকা‘আত বিতর পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।

হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন:

أَجْمَعَ الْمُسْلِمُوْنَ عَلٰى أَنَّ الْوِتْرَ ثَلَاثٌ لَا يُسَلِّمُ إِلَّا فِيْ آخِرِهِنَّ.

অর্থ: বিতর নামায তিন রাকা‘আত হওয়ার বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ইজমা (ঐক্যমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (ইবনে আবী শাইবাহ: ৪/৪৯২, হা. নং ৬৯০৪)


Comments

Popular posts from this blog

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ