কেমন ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীর কাউয়ুম জামান আবু নসর আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহঃ)






কেমন ছিলেন ফুরফুরা শরীফের গদ্দিনশীন পীর কাউয়ুমে জামান হযরত মাওঃ আবু নসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহঃ) [ওয়াফাতঃ১৯৭৭] 
                                       
একটি মনোরম দিনের সুন্দর সকাল। অপূর্ব সাজে সজ্জিত পৃথিবী। চারিদিকে রক্তিম আলো শুশোভিত পত্র-পল্লবে প্রাণের সঞ্চার করেছে।

ধরার বুকে স্রষ্টা যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছেন। এরই মাঝে খাদেম এসে সবিনয়ে আরজ করলো হুজুর কি নাস্তা করবেন? একটু চিন্তা করে হুজুর বললেন বাবা, নাস্তা যে করব পয়সা কোথায় ? কথা বলতে বলতে পকেটে হাত রাখলেন। পকেট থেকে দু-পয়সা বের করে দিয়ে বললেন, এক পয়সার চিড়া ও এক পয়সার চিনি নিয়ে এসো।

হুকুম পেয়ে খাদেম দোকান খেকে চিড়া ও চিনি নিয়ে এলো। যতটুকু আনা হলো হুজুর তা থেকে কিছুটা খেলেন। বাকীটা রেখে দিতে বললেন। এমন সময় দোঁক মাদ্রাসার পরিচালক হাজি ফয়জুর রহমান সাহেব এসে হাজির হলেন।

হুজুর বললেন বাবা নাশতা করেছেন কি? ওখানে চিড়া-চিনি রাখা আছে, নাশতা করে নিন। হাজি সাহেব হুকুম পালন করে নাশতা করলেন। তারপর হুজুরের খেদমতে হাজির হয়ে আদবের সাথে বললেন হুজুর, মাদ্রাসার মোদারেস সাহেবদের বেতন বাকী। এজন্য বার শত টাকা প্রয়োজন। কথাটি শেষ হতে না হতেই হুজুরের চেহারায় পরিবর্তনের ছাপ দেখা গেল। তিনি বিচলিত হয়ে পড়লেন। তার কোমল হৃদয় যেন ডুকরে কেঁদে উঠল। কাল বিলম্ব না করে তিনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের কষ্টার্জিত বারশত টাকা হাজি সাহেবের হাতে তুলে দিলেন। মূলত তাঁর চেষ্টা ও চিন্তার সবটাই ছিল দীনের উন্নতির জন্য নিবেদিত। দুনিয়ার আরাম-আয়েশের আকাঙ্খী তিনি কখনও ছিলেন না। দুনিয়ার প্রতি তিনি ছিলেন উদাসীন। আর তাই নিজের জন্য নয়-মহান ধর্ম ইসলামের জন্য তিনি অকাতরে সব দান করে গেছেন। বলা হয়ে থাকে, দীনের খেদমতের জন্য তিনি তার জান ও মালকে ওয়াক্ফ করে জীবন কাল অতিবাহিত করেছেন।

উল্লেখিত ঘটনার মাধ্যমে এ মহান বুজুর্গের পুরো জিন্দেগীর একটি ছবি ফুটে উঠেছে। তার চরিত্র শোভাকে জানার জন্য মনের স্পৃহা বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়ার মত উন্নত উপকরণ এ ঘটনায় মওজুদ রয়েছে। যার কথা বলছি তিনি হলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ হাদী, ফূরফুরা শরীফের গদ্দিনশীন হযরত মাওলানা আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.)। বাংলা ভারত সর্বত্র তিনি বড় হুজুর নামে সমাধিক পরিচিত ছিলেন।

গরীব ছাত্রদের স্বল্প খরচে মফঃস্বল এলাকায় টাইটেল পড়তে সুযোগ করে দেয়ার জন্যে বড় হুজুর (রহ.) সরকারের কাছে ফুরফুরা টাইটেল মাদ্রাসা মঞ্জুরী করার দাবী জানান। তৎকালীন প্রিন্সিপাল জনাব সৈয়দ আবুল আলা বরকতী সাহেব এটা শুনে হুজুরকে জানালেন যে , টাইটেল মাদ্রাসা খুলতে গেলে প্রথমে ৬ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। একথা শুনে হুজুর বললেন, শুধু ছয় হাজার টাকা কেন, যদি নিজের কলজে ছিড়ে দিতে হয় তা হলেও আবদুল হাই দিতে রাজী আছে।
হযরতের খলিফা মাওলানা আইয়ুব সাহেব (রহ:) বর্ণনা করেন :
বড় হুজুর (রহ.) বাগের হাট থেকে জলসা করে ফিরছেন। পথে অনেক লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে হযরতের গাড়ী থামিয়ে অনুরোধ জানালো, হুজুর! আমাদের এখানে নতুন মসজিদ তৈরী হচ্ছে। এলাকার লোকদের আরজু আপনি একটু দোয়া করে মসজিদটি উদ্বোধন করে দিয়ে যাবেন। হুজুর গাড়ী থেকে নেমে মসজিদে দোয়া করলেন। সাথে পাঁচ হাজার টাকা ছিলো। সবগুলো টাকা মসজিদ ফান্ডে দান করে দিলেন।

ফুরফুরা শরীফের প্রবীণ খলিফা মাগুড়ার হযরত পীর খন্দকার আবদুল হামীদ (রহ.) বর্ণনা করেন ঃ একদিনের ঘটনা। সকাল থেকে জোহর পর্যন্ত বড় হুজুর (রহ.) ফুরফুরা শরীফের তার দরবার কক্ষে বসে ছিলেন। বহু লোক হুজুরের সাথে দেখা করতে আসলো। তারা হুজুরকে এত হাদিয়া দিলো যে টাকার স্তুপ হয়ে গেল। হুজুর ম্যানেজারকে হুকুম দিলেন,এ টাকা থেকে অমুক মাদ্রাসায় এত, অমুক এতিমখানায় এত, অমুক মসজিদে এত পাঠিয়ে দাও। এভাবে মাদ্রাসা মসজিদে দান করে দিলেন। এমন সময় একটি লোক এসে বললো, হুজুর মেজ সাহেবজাদার টুপীটা ছিড়ে গেছে। একটা নতুন টুপী কিনতে হবে। হুজুর তার হাতে চার আনা পয়সা দিয়ে বললেন এ পয়সা দিয়ে ওর টুপী কিনে আনো।
একবার চোখের রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার দৃষ্টিশক্তি খুব কমে গিয়েছিল। রাতের বেলা দেখতে পেতেন না বললেই চলে। এমতাবস্থায়ও তিনি নামাজের জামাআতে শরীক হতেন। একদিন সাথে কেউ না থাকায় একাই এশার নামাজ পড়বার জন্যে ঘর হতে বের হলেন। হাতরাতে হাতরাতে মসজিদের দিকে চললেন। পথে গাছের একটি বড় ডাল পড়েছিল। কিন্তু তিনি সেটা দেখতে না পেয়ে সোজা হেঁটেই চললেন। ফলে হোচট খেয়ে পড়ে গেলেন এবং মারাত্বকভাবে আহত হলেন।

১৯৪৪ বা ৪৫ সালের ঘটনা। কাউয়ুমে জামান আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.) বর্ধমান জেলায় তাঁর শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথে ইস্তেঞ্জার হাজত হওয়ায় গাড়োয়ানকে গাড়ী থামাতে বললেন। গাড়ী থেমে গেলে হযরত গাড়ী থেকে নামলেন। ইস্তেঞ্জার পর একটি কুলুখ নিয়ে হেঁটে হেঁটে ২/৩টা জমি পার হয়ে গেলেন। ঢেলাটি ফেলে দিতে গিয়ে হঠাৎ চমকে ওঠলেন। তারপর সেখানে ঢেলাটি না ফেলে পুনরায় প্রথম জমিতে ফিরে এসে যেখান থেকে ঢেলাটি উঠিয়েছিলেন ঠিক সেখানে সেটি ফেলে দিলেন। অতঃপর কাপড় ঠিক করে বললেন এক জমি হতে মাটি নিয়ে অন্য জমিতে ফেলে দেয়া তাকওয়ার খেলাপ। ঐ জমিতে ঢেলাটি ফেলতে গিয়ে আমার স্মরণ হলো যে, ঢেলাটি ঐ জমির নয়। তাই ওটাকে এখানে ফেললাম।

বড় হুজুর (রহ.) প্রথম জীবনে সফরে বাসে অথবা ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীতে যাতায়াত করতেন। একদিন তিনি ভানকুনি ষ্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেনের তখন প্রায় এক ঘন্টা দেরী। তাঁকে সাধারণের মত একই স্থানে বসে থাকতে দেখে মহানুভব ষ্টেশন মাষ্টার বললেন আপনি পুণ্যবান মানুষ। আসুন, ফাষ্ট ক্লাসের ওয়েটিং রুম খুলে দেই। একটু বিশ্রাম করবেন। হযরত বড় হুজুর (রহ.) তখন বললেন, আমি চন্দননগর যাবো থার্ড ক্লাসে, কাজেই ফার্ষ্ট ক্লাসের ওয়েটিং রুমে বিশ্রাম করা আমার জন্য জায়েজ হবে না। সুতরাং আমি ওখানে যাবো না। হযরতের উত্তর শুনে ষ্টেশন মাষ্টার তাঁকে বিষ্ময়ে দেখতে লাগলো।

বড় হুজুর (রহ.) কুষ্টিয়া এক মাহফিলে যাচিছলেন। গড়াই নদীর পার হয়ে যেতে হবে। হুজুর ঘোড়ার গাড়ীতে যাচ্ছিলেন। তখন সভাস্থল কয়েক মাইল দূরে। কিন্তু রাস্তা এত কর্দমাক্ত ছিলে যে ঘোড়ার চলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। হযরত ঘোড়ার কষ্ট দেখে গাড়ী থামাতে বললেন । সাথীদের বললনে, এ হাটু কাঁদা ডিঙ্গিয়ে ঘোড়ার পথ চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। ওকে আর কষ্ট দিয়ে কাজ নেই। চলো আমরা হেঁটে যাই। একথা বলেই হুজুর হাঁটা শুরু করলেন এবং এ কাঁদার মধ্যে দিয়ে কয়েক মাইল পথ হেঁটে নদী পার হয়ে মাহফিলে উপস্থিত হলেন ।

১৯৭৫ সাল। ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে বড় হুজুর (রহ.) এর জলসা। হুজুর গাড়ী থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। এমন সময় এক লোক এসে এমনভাবে হুজুরের পা জড়িয়ে ধরলো যে, হুজুর প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। মারাত্বক ভাবে পা মচকে গেল। হাঁটা চলাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো।

পরদিন ঐ লোক ৬০ হেমেন্দ্র দাস রোড, বাংলাবাজারস্থ খানকাহ শরীফে হুজুরের কাছে মাফ চাইতে আসলো। হুজুর তাকে মাফ করে দিয়ে সামান্য একটু ধমক দিলেন না, বরং মুচকি হেসে বললেন, বাবা কালতো আমার পাটা ভেঙ্গেই ফেলেছিলে আর কি?[ বর্ণনাকারী: হযরত মাওলানা আবুল বাশার জিহাদী সাহেব]

ঝিনাইদহে এক বাড়ীতে দাওয়াত। বড় হুজুর (রহ.) খেতে বসেছেন। বেশ কিছু খেয়ে ফেলেছেন। সাথীরা মাত্র দু এক লোকমা মুখে দিয়েছেন। এমন সময় হুজুর বলে উঠলেন, বাবারা, খানায় বিষ মেশানো হয়েছে। কেউ খানা স্পর্শ করবে না। পরে অনুসন্ধান করে অপরাধীকে হুজুরের সামনে আনা হ’ল। হুজুর তাকে মাফ করে দিলেন।

বিষ মেশানো খানা খাওয়ার পরও আল্লাহর রহমতে বড় হুজুর (রহ.)-এর কিছুই হল না । কিন্তু সাথী যারা ২/১ লোকমা খেয়েছিলেন, তারা বহুদিন পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন।

বড় হুজর (রহ.) এর বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন তাঁর সাথে ভীষণ শত্রুতা পোষণ করতো। তিনি যখন ওয়াজ করতেন, তখন তারা বলতো, এতো ওয়াজ হচ্ছে না, যেন ঢোল বাজাচ্ছে। এ ছাড়া সব সময় হুজুরের বিরুদ্ধে লেগেই থাকতো। কিন্তু তিনি কখনও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না। কলকাতার বাড়ীতে এসকল আত্মীয়-স্বজনের জন্যে তিনি দুটি আলাদা কামড়া তৈরী করে দিয়েছিলেন, যাতে করে কলকাতায় আসলে তাদের কোন কষ্ট না হয় এবং এ কামড়াগুলোতে তারা বিশ্রাম নিতে ও রাত্রি যাপন করতে পারে।

ইসলামী বিশ্বকোষে বড় হুজুর (রহ.)
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য ২৫ খন্ডে প্রায় ২০,০০০ (বিশ হাজার) পৃষ্ঠার বিস্তারিত ইসলামী বিশ্বকোষ প্রণয়ন করেছে। কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শত শত আলেম নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও সমাদৃত এই বিশ্বকোষের প্রথম খন্ডে ফুরফুরার হযরত বড় হুজুর আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.) এর উপর একটি মূল্যবান, তথ্য বহুল ও সারগর্ভ নিবন্ধ সংযোজিত হয়েছে। ইসলামী বিশ্বকোষ ১ম খণ্ডে ৫১৯-৫২০ পৃষ্ঠা থেকে উক্ত নিবন্ধটি এখানে হুবহু তুলে ধরছি।

আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.) মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল হাই, কুনিয়াত আবু নসর, বংশীয় উপাধী সিদ্দিকী।
উপমহাদেশের একজন মুহাককিক আলেম, বিখ্যাত ওয়াইজ, সমাজ সংস্কারক, হাক্কানী পীর ও সুফি; উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁহার বিশেষ অবদান ছিল। ১৩২৩/ ১৯০৩ পৌষ ১৩১০ বঙ্গাব্দে তিনি ভারতের পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলার ফুরফুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম মাওলানা শাহ সুফি আবু বাকর সিদ্দিকী (রহ.) যিনি আমীরুশ শারআত ও মুজাদ্দিদ-ই যামান বলিয়া খ্যাত। তাঁহার মাতা নেজিয়া খাতুনও বিদূষী মহিলা ছিলেন। কথিত আছে যে, পিতা ও মাতা উভয়েরই বংশীয় নিসবাত ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বাকর সিদ্দীক (রা.) এর সহিত রহিয়াছে। সেই কারণে তাঁহারা সিদ্দিকী উপাধি ধারণ করিয়া আসিতেছেন। আব্দুল হাই পিতার জেষ্ঠ্য পুত্র। তাঁহার লেখাপড়া শুরু হয় গৃহে মাতার কাছে। ৬ বৎসর বয়সে তাঁহাকে ফুরফুরা মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। এখান হইতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তাহাকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি করিয়া দেওয়া হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া তিনি পিতার সান্নিধ্যে থাকিয়া ইলম-ই জাহির ও ইলম-ই বাতিন এর উপর প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বাংলা ১৩৩০ সনে তিনি পিতার সহিত হজ্জ ও যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মক্কা মুআজজামা ও মদীনা মুনাওয়ারায় যান। দেশে প্রত্যাবর্তন করিয়া তিনি পিতার সহিত বাংলা ও আসামের বিভিন্ন স্থানে যাইয়া ইসলাম প্রচার করিতে থাকেন। দীনী জলসা ও মাহফিলে পিতার সহিত যোগদান করিয়া তিনি লক্ষ মানুষের সামনে ওয়াজ-নাসীহাত করিতেন। কুরআন হাদীস, ফিকহ, আকাইদ, মানতিক, ফালসাফা, ইতিহাস এবং কাব্য সাহিত্যে তিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ফারসী এবং উর্দূ কাব্যেও তাঁহার দখল ছিল।

 তাঁহার পিতার ইন্তিকালে (২৫শে মুহাররাম ১৩৪৫/১৭ই মার্চ ১৯৩৯) তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং পিতার আরদ্ধ কার্যাবলী সম্পন্ন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পিতার ন্যায় তিনিও শিরক, বিদআত ও কুফরীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। সমাজে বিরাজিত যাবতীয় অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার ও ইসলাম বিরোধী আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন। খৃষ্টান মিশনারীদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধেও তিনি রুখিয়া দাঁড়ান।

তাঁহার পিতার ইন্তেকালে আঞ্জুমানে ওয়ায়েজীন ও জমিয়তে ওলামায়ে বাংলার সভাপতির দায়িত্ব তাঁহার উপর অর্পিত হয়। এই সময় যশোর, নদীয়া, দিনাজপুর বগুড়া প্রভৃতি অঞ্চলে খৃষ্টান মহিলা মিশনারীরা পলদীতে যাইয়া সরলমনা মুসলিম মহিলাদেরকে খৃষ্টান বানাইবার চেষ্টা করিতেছিল। তিনি আঞ্জুমানে ওয়ায়েজনি এর সদস্যগণ এ সমস্ত অঞ্চলে প্রেরণ করেন। ফলে খৃষ্টান মিশনারীদের এ প্রচেষ্টা অনেকটা ব্যর্থ হয়। তাঁহার নেতৃত্বে জমিয়ত ওলামা ভারতে মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। তদান্তীন নিখিল বাংলা ও আসামে তাঁহার নেতৃত্বে জমিয়তে ওলামা শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। জমিয়তে ওলামায়ে বাংলার লক্ষ্য ছিল শারী ’আতী সমাজ গঠন ও স্বাধীনতা অর্জন। ১৯৪৬ খৃষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, পশ্চিম বাংলা, আসাম ও পূর্ববংগ (বর্তমান বাংলাদেশ) হইতে পাকিস্তান সমর্থনকারীদের সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন লাভের পশ্চাতে তাঁহার অশেষ অবদান ছিল।

তিনি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন , জমিয়তে ওলাময়ে হানাফীয়া, সিদ্দিকীয়া নূরুল ইসলাম বায়তুল মাল, হিযবুল্লাহ প্রভৃতি। মানবজাতির কল্যাণে তিনি নিবেদিত ছিলেন। তাই তিনি ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে খেদমতে খালক ও ইশাআতে ইসলামের জন্য শেষোক্ত সংগঠন বিশ্ব ইসলামে মিশন কুরআন কুরআনী সুন্নীজমতুল ঈয়তুল মুসলিমীন হিযবুল্লাহ গঠন করেন। লিখনী, বক্তৃতা, পত্রিকা প্রকাশ, গবেষণা ও মানব সেবার মাধ্যমে সুন্দর ব্যবহার ও হিকমাতের সহিত মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করাই এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।

তিনি বাংলা ভাষায় পত্র পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগও গ্রহণ করেন। আশ্বিন ১৩৫০/ রামদান ১৯৬২ সালে তাঁহার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কলকাতা হইতে নেদায়ে ইসলাম নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অদ্যাবধি কলকাতা ও ঢাকা হইতে পৃথক পৃথক ভাবে এই মাসিক পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হইতেছে। ১৯৭৯ খৃষ্টাব্দে ঢাকা হইতে তাঁহার নির্দেশে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক মানবতা। তাঁহার রচিত বহু প্রবন্ধ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহার নির্দেশে ও তত্বাবধানে প্রচুর ইসলামী পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছে। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। নারীশিক্ষার প্রতি তিনি অত্যাধিক জোর দিতেন। তিনি বলিতেন, “কেবল মাত্র পুরুষ শিক্ষা ও প্রগতির দ্বারা সমাজের জাগরণ আসে না। নারী জাতিরও শিক্ষা সংস্কারের বিশেষ প্রয়োজন। [সিরাজুল ইসলাম হযরত মওলানা আবদু’ল হাই সিদ্দিকী (রহ.) এর জীবন ও বাণী পৃ .৩১]।

তাঁহার পৃষ্ঠপোকতায় ফুরফুরার অদূরে অবস্থিত চকতাজপুর নামক স্থানে পশ্চিম বংগ সিদ্দীকা গার্লস হাই মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদরাসার ছাত্রীদে জন্য ইহার সংলগ্ন ছাত্রীবাসও নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে ভারত বিভক্তির পর ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র কলকাতা ‘আলিয়া মাদরাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হইলে পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা ইসলামী শিক্ষা গ্রহণে এক সংকটের সম্মুখীন হয়। তাঁহার প্রচেষ্টায় ভারত সরকার পুনরায় কলকাতা ‘আলিয়া মাদরাসা চালু করেন। পুনরায় মাদ্রাসা বোর্ড ও মাদ্রাসাসুমুহ সরকারী নিয়ন্ত্রণে আসে। (দ্র..কলকাতা ‘আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্র পরিচিত, ১৯৭১)।

মাওলানা আদুল হাই সিদ্দিকী পশ্চিম বংগ, আসাম, বিহার ও বাংলাদেশ-এর লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্তরকে ইলম-ই তাসাওউফ-এর শিক্ষা দ্বারা উদ্ভাসিত করিয়াছেন। তাঁহার মুরীদের সংখ্যা অসংখ্য। ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও তাঁহার ভক্ত ও মুরিদ আছে। তিনি মুরিদগণকে কাদিরিয়া, নাকশাবন্দীয়া, মুজাদ্দেদিয়া ও মুহাম্মাদীয়া তারীকার সবক দিতেন।
বিভিন্ন স্থানে তিনি খানকাহ্ স্থাপন করেন। পাবনা জেলার পাকশীতে স্থাপন করেন, একশত স্তম্ভ বিশিষ্ট একটি খানকাহ। ইহার নাম রিয়াযুল জান্নাত। ঢাকার মীরপুর এলাকায় অবস্থিত দারুস্সালামেও তিনি একটি খানকাহ স্থাপন করেন। এই খানকাহ হতে প্রতি বৎসর ইসালে ছাওয়াব-এর মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হয়।

তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ওয়াইজ ছিলেন। তাঁহার ওয়াজ শুনিবার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড় জমিত। সকল শ্রেণীর মানুষের অন্তরে তাঁহার ওয়াজ এমনভাবে রেখাপাত করিত যে, শ্রবণকারীর অনেকেই সত্যিকারের ইসলামী যিন্দিগীতে ফিরিয়া আসে। আজীবন তিনি দীন ইসলামের বাণী পৌঁছাইবার উদ্দেশ্যে নিরলসভাবে ভারতের নানা জায়গায় এবং বাংলাদেশের গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ওয়াজ নাসীহাত করিয়া মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করিয়াছেন। তিনি তাঁহার অধিকাংশ সভাতেই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে বক্তব্য রাখিতেন। রাজনীতিও বাদ যাইত না। তিনি বলিতেন ঃ স্বাধীনতা ও মানবতা দুইটি কথা। যেখানে স্বাধীনতা নাই, সেখানে মানবতা নাই। আর মানবতাহীন স্বাধীনতা মুল্যহীন (দ্র. মুহাম্মাদ সিরাজু’ল ইসলাম, হযরত মাওলানা আব্দুল-হাই সিদ্দিকী (রহ.) এর জীবন ও বাণী, পৃঃ ১৩৭, কলকাতা, মার্চ ১৯৮৩) তিনি অত্যন্ত সাদাসিধা জীবন যাপন করিতেন। তিনি ১৯৬৭ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার হজ্জ পালন করেন। তাঁহার জীবনে বহু কারামত প্রকাশিত হয় বলিয়া তাঁহার জীবনী গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হইয়াছে। কেহ কেহ তাঁহাকে কায়্যূম-ই যামান আখ্যায়িত করিয়াছেন। ১৯৭৭ খৃষ্টাব্দের ১২ই মে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হইয়া তিনি কলকাতার সেন্ট মারিস নার্সিং হোমে ভর্তি হন এবং ২৪শে বুমাদা’ল-আওওয়াল ১৩৯৭/ ১৩ই মে ১৯৭৭ /৩০ শে বৈশাখ ১৩৮৪ শুক্রবার দিবাগত রাতে ১১ ঘটিয়ায় উক্ত নার্সিং হোমেই ইন্তেকাল করেন। ১৪ই মে রবিবার অপরা‎েহ্ন তাঁহাকে ফুরফুরা গ্রামে তাঁহার পিতার মাজারের পাশে দাফন করা হয়।

হযরত বড় হুজুর (রহ.) এর সংস্কারমূলক কর্মসূচীঃ
সাড়ে সাত শত বছরের মুসলিম শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের যে এক চেটিয়া দখরলদারিত্ব ছিল ১৯৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে তার দৃঢ় ভিত নড়ে যায় প্রচন্ড ভাবে গোলামীর জিঞ্জরে আবদ্ধ হয়ে হারানো গৌরবের শোকে মুহ্যমান মুসলিম জাতি একদিকে হয়ে পড়ে নিস্ক্রিয়, অপরদিকে ইংরেজদের অত্যাচার-উৎপীড়ন, জেল-জুলুম, বেপরোয়া ফাঁসি এবং হিন্দুদের মুসলিম নিধন যজ্ঞে মুসলিমরা একে একে হতে থাকে দুর্বল। ধর্ম চিন্তা, নৈতিকতা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে দেখা দেয় চরম বন্ধ্যাত্ব ও এবং অধঃপতন।
১৭৯৯ সালে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ.) এর চিন্তাধারায় আপ্লুত মহীশুরের টিপু সুলতানের ইংরেজদের কাছে পরাজয় এবং সর্বশেষ ১৮০৫ সালে দিল্লী ইংরেজদের দখলে চলে গেলে মুসলমানদের অবশিষ্ট মনোবল একেবারে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। ১৮৩১ সালে বালাকোটের ময়দানে সৈয়দ আহমদ বেরেলভী (রহ.) এর শাহাদাত এবং পরবর্তীতে ইং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যাবার পর উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবনের ন্যায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনও সংকীর্ণ ও দুর্বিসহ হয়ে ওঠে।

এমনই এক পরিস্থিতিতে শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মোঃ আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.) যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করলেন, তখন সমাজের যে অবস্থার চিত্র তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠলো তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ

    মুসলমানরা শিক্ষা দীক্ষায় চরমভাবে পিছিয়ে পড়েছিল। মুসলামানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল একেবারে নগন্য।
    হিন্দুরা সর্ব প্রকার সুযোগ পেয়ে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের অধিকাংশ বড় বড় পদসহ জমিদারী পর্যন্ত বাগিয়ে নিয়েছিল। অপরদিকে মুসলমানরা হয়ে পড়েছিল অস্পৃশ্য, মুর্খ, নির্যাতিত গরীব প্রজা। হিন্দু রাজা ও জমিদাররা মুসলমানদের ঐতিহ্য ধ্বংস করার জন্য অর্থনৈতিক নিপীড়নের সাথে সাথে ধর্মীয় ব্যাপারে বিপর্যয় ঘটানোর সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল।
    আশরাফ-আতরাফের শ্রেণীভেদ, বংশ গৌরব ও জাতি বৈষম্য মুসলিম সমাজকে জর্জরিত করে তুলেছিল। কুলি, তাঁতী, তৈলী, চাষী প্রভৃতি পেশাজীবী লোকদের হেয় দৃষ্টিতে দেখা হ’ত এবং তাদের সাথে কোন আত্মীয়তা করতে মানুষ ঘৃণা করতো।
    তাড়ী, মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম, সুদ-ঘুষ, গান বাজনা, বেনামাজ, বে-পর্দা ইত্যাদিতে সমাজ ছেয়ে গিয়েছিল।
    বিভিন্ন বিদয়াতী ফকীরের অতি জঘন্য দল ও মত সমাজের সর্বস্তরে শিখড় গেড়ে বসেছিল।
    কবরপূজা, কবর চুম্বন, হাজত-মানত করা, বিনা প্রয়োজনে কবরে বাতি জ্বালানো, কাওয়ালীর মজলিস করা, মহরম মাসে তাজিযা বের করা, ইমাম হোছাইনের দরগাহ তৈরী করা, পীরের নামে অজীফা পড়া, ফকীরি বিদ্যা, সিনায় সিনায় আসা, জ্বীন হাসিল করা মৃত পীর বা নবীকে মজলিসে হাজের নাজের জানা, পীরের কবরকে গোসল দিয়ে সেই পানি পান করা উত্তর, পশ্চিম কোনে বোগদাদী সিজদা করা, কুরআন শরীফ ৪০ পারা ধারণা করা এবং তন্মধ্যে ১০ পারা ফকীরদের সিনায় সিনায় আসা, শরিয়ত থেকে মারেফাতকে ভিন্ন জানা, নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পেটে বাঁধা পাথর পাবার দাবী করা ওয়াজের মজলিশে মিথ্যা হাদীস বলা, সৈয়দ ছাড়া অন্য কেউ পীর হতে পারবে না ধারনা করা, সূর্য অস্তের দশ মিনিট পর ইফতার করা ইত্যাদি হাজারো বাতেল, কুফরী ও শেরেকী আকীদা ও কার্যাবলীতে সমাজ ছেয়ে গিয়েছিল।
    মুসলমানরা এত নীচে নেমে গিয়েছিল যে, গোড়া পীর, তেনা পীর, মানিক পীর, সত্য পীর, ইটা পীর, ভিটা পীর, ঢেলা পীর ইত্যাদির নামে মানত, সিন্নি , উরস্ বা স্মৃতি বার্ষিকী মেলা করাই ছিল তাদের কাছে ধর্মানুষ্ঠান।
    নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার, ইংরেজদের পাচাটা গোলাম হুজুরে পাক (দ.)-এর খতমে নবুওয়াতকে অস্বীকারকারী ভন্ড মুর্তাদ মীর্জা গোলাম আহমদ প্রবর্তিত কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রচারকার্য তখন পূর্ণোদমে চলছিল। বিচারপতি জাষ্টিস স্যার জাফরুল্লাহ খান, মুহাম্মদ আলী (এম, এ এল এল বি) খাজা কামাল উদ্দীন (লন্ডন ওকিং মসজিদের ইমাম)সহ বহু উকিল, ব্যারিষ্টার, মাষ্টার ও উচ্চ রাজকর্মচারীগণ কাদিয়ানী ধর্মমত গ্রহণ করে ইসলামের ছদ্মাবরনে এই মতবাদের প্রচার কার্য চালাচ্ছিল। সরল বিশ্বাসে তাদের কথা মেনে নিয়ে বেঈমান হচ্ছিল বাংলার মুসলমান।
    শিয়াদের আকীদা-বিশ্বাস এবং রুসুম-রেওয়াজ সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। আশুরার দিন কারবালার স্মরণে তাজিয়া বের করে, বুক চাপড়িয়ে মাতম করে এবং আরও অনেক বেশরা কাজ করে শোক প্রকাশ করা হত।
    খৃষ্টান মিশনারীদের ব্যাপক প্রচারাভিযানের ফলে এদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানরা দলে দলে খৃষ্টান হয়ে যাচ্ছিল।
    কমূনজম বা নাস্তিকতাবাদ তখন বাংলার মাটিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল।
    খারেজী, মোতাজিলী ও কাদরিয়া, জবরিয়া দলের প্রসার ঘটাতে শুরু করেছিল।
    হিন্দুয়ানী ধ্যান-ধারণা ও পূজা পার্বন মুসলিম সমাজে বিস্তার লাভ করেছিল। মুসলমান পুরুষ ও মহিলারা দল বেঁধে হিন্দুদের পূজায় শরীক হতো, পূঁজায় চাঁদা প্রদান ছাড়াও মুসলমানরা লক্ষ্মী পূজা, স্বরস্বতী পূজা, পদ্মাদেবীর পূজা, ওলাউটা দেবীর পূজা, শীতলাদেবীর পূজা করতেও মোটেই ইতস্তত করত না। ঠাকুর ঘরে মানত মানা সাধারণ ব্যাপার ছিল। সুলক্ষন ও কুলক্ষণ, যাত্রা অযাত্রা, বিয়ের দিন তারিখ, অমাবশ্যা পূর্ণিমা ইত্যাদি নিয়ে হাজারো কুসংস্কারে সমাজ ছেয়ে গিয়েছিল।
    মুসলামনী পোষাক ছেড়ে সার্ট, প্যান্ট, কোট, টাই, ধূতি ইত্যাদি বিজাতীয় পোষাক পরিধান করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি মুসলমানদের হিন্দুয়ানী নাম রাখা হ’ত এবং নামের পূর্বে শ্রীযুক্ত হত।
    সুদ খাওয়া, সুদী কারবার করা, জমি বন্ধক রাখা, সুদ জাতীয় পন্থায় জমি ও ফসলের কারবার করা এদেশে মারাত্মক ব্যাধির ন্যায় বিস্তার লাভ করেছিল। খুব সংখ্যক লোক পাওয়া যেত যারা সুদ খেতো না।
    বিয়েতে পণ প্রথা, হলুদ বাটা, গায়ে হলুদ, ফুরুল সাজান, পাত্র-পাত্রী নামে দিয়ার ভাসান ইত্যাদি কঠিন গুনাহর কাজ শরিয়তী ইসলাম আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
    নতুন নতুন মিথ্যা মাজার ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছিল এবং সেগুলো গাঁজাখোর, লম্বাচুলধারী মেয়ে পুরুষে পাশবিক ভোগের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছিল। এছাড়া গ্রামে গঞ্জে, হাটে-বাজারে বাউল ফকীরদের গান বাজনা আর গাজার আসর গড়ে উঠেছিল। ভন্ড পীরে ছেয়ে গিয়েছিল গোটা দেশ।
    গ্রামে-গঞ্জে বিরাট বিরাট মেলা বসতো। এ সকল মেলায় নারী পুরুষের সমাগমসহ যাদু তেলেসমাতি, নাচ-গান, জুয়া, ঘোড়-দৌড়, নৌকা-বাইচ ইত্যাদি বেশরিয়ত কাজকর্ম চলতো।

মোটকথা- ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের উপরও তখন অনেকটা তদ্রুপ জাহিলিয়াত তথা মুর্খতা চেপে বসেছিল।

[(১) স্মরণিকা সিদ্দীকিয়া ৪ঠা জানুয়ারী ৯৪, ২) হযরত আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.) এর জীবনী মুহাঃ ইব্রাহিম তর্কবাগীশ, (৩) হযরত আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.) এর জীবন ও বাণী-মাওলানা সিরাজুল ইসলাম]                          ((প্রথম পর্ব শেষ )

Comments

Popular posts from this blog

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ