ফিকহে হানাফী নিয়ে অপপ্রচার ও তার প্রতিবাদ



আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ। বর্তমানে মুসলিম সমাজের যে অবস্থা তার দিকে লক্ষ করে বিভিন্ন মাসলাকি মতবিরোধ নিয়ে লেখা বন্ধ প্রায় করেই দিয়েছিলাম। কিন্তু ওয়ালয়ে প্রায় দেখি বিতর্ক মূলক পোষ্ট ভেষে আসে। তেমনি একটি বিষয় হলো ''ইমাম আবু হানিফা রহঃ বলেছেন 'ইযা সাহহাল হাদিস ফাহুয়া মাজহাবী' অর্থাৎ হাদিস যখন  সহীহ পাবে সেটিই  আমার মাজহাব। এই বিষয়টি আলোকপাত করার আগে আরেকটা বিষয় বলে নিতে চাই আর সেটা হলো আমাদের সমাজে কচুরিপানার মত ভেসে উঠা আহলে হাদিস জামাতের একটি অংশ যাদের অভ্যাস হলো মাদখালিদের মত অর্থাৎ একমাত্র নিজেদেরকেই সঠিক প্রমান করে বাকিদের বাতিল প্রমানে সর্বদা সচেষ্ট থাকাকে তাদের দাওয়াহ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য বানিয়ে নেওয়া।  এরা এধরনের চিন্তাধার শিকার হয়েছে বলতে পারি, এও বলতে পারি এদেরকে শিকার করা হয়েছে । শিকার কিভাবে করা হয়েছে দেখা যাক।
আমরা সকলেই জানি ফিকহে হানাফি অথা হানাফি মাজহাবের সূচনা খাইরুল কুরুনেই। খাইরুল কুরুন বলাহয় সাহাবা, তাবেইন ও তাবে-তাবেইনদের যুগকে আর ইমাম আবু হানিফা রহঃ তাবেই ছিলেন এতে সর্বজন স্বীকৃত। একসময় আহলে হাদিসদের একদল আলিম হানাফিদের সাথে বিদ্বেষী রেখে হানাফি মাজহাবের উপর মিথ্যাচার ও ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর উপর অপবাদ আরোপিত করার মাধ্যমে হানাফিদের কাছে তাদের দাওয়াতি কর্মকাণ্ড প্রচার করে চলেছিলো কিন্তু যখন হক্ক পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলো, যখন এদের মিথ্যাচার ও অপবাদের স্বরূপ উন্মোচন একেরপর এক উলামায়ে আহনাফ করে যাচ্ছিলেন তখন হটাৎ করে ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর উপর এদের দরদ বেড়ে উঠার নাটক শুরু করার পন্থা খুঁজে সেগুলি দিয়ে হানাফিদের ভুল বুঝাতে লাগলো। যার মাঝে একটি হলো ' হাদিস যখন সহীহ পবে সেটিই  আমার মাজহাব'।
এর দ্বারা তারা সরলমনা সুন্নাহ প্রেমি মুসলিম ভাইদের নিকট বুঝাতে লাগলো যে, সহীহ হাদিস মানাটাই
হানাফি মাজহাবের একমাত্র উসুল ও নীতি আর সেই সহিহ হাদিস হবে যা বুখারী ও মুসলিমেই লিপিবদ্ধ। সুতরাং দাওয়াতের নামে বুখারী ও মুসলিমকে অস্ত্র বানিয়ে সরলমনা সুন্নাহ প্রেমিক ভাইদের নিকট দেখাতে লাগলো এই দেখো তোমাদের আমল ও বুখারী, মুসলিমে লিখিত সহিহ হাদিসের আমলে কত তফাৎ। বিশেষকরে তারা নামাজের আমলগুলি যেমন রাফউল ইয়াদাইন করা, জোরে আমিন ইত্যাদি বিষয়গুলিকে হাইলাইট করলো। এর দ্বারা সেসব সরলমনা ভাইয়ের সহজের তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেললো। ভাবলো হ্যাঁ তাইতো সহিহ হাদীসের সাথে  আমাদের আমলের বেশকিছু ফারাক আছে!!
সম্মানিত ভাইয়েরা আসলেই কি হানাফী মাজহাব সহীহ হাদিসের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে?
মোটেও না। আমরা যারা এবিষয়ে নিরপেক্ষ ভাবে পড়াশুনা করেছি বা করবো তাঁরা অবশ্যই জানবো হানাফি মাজহাব মোটেও সহীহ হাদিসকে অস্বীকার করেনি বরং কুরানের পরে সহিহ হাদিসকেই অগ্রাধিকার বেশি দিয়েছে।
ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর মাজহাবের উসুল শুধু সহীহ হাদিসই নই বরং সুন্নাহের প্রত্যেকটি স্তরকে জমা করা।
এবিষয়ে ইমাম সাহেব রহঃ বলেন,
আমি কিতাবুল্লায় বিধান পেলে তা সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করি। তাতে না পেলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ এবং তাঁর ঐ সকল সহীহ হাদীস থেকে যা নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
(আখবারু আবী হানীফা ওয়া মানাকিবুহু)

আমারা দেখতে পেলাম ইমাম সাহেব রহঃ মাজহাব সংকলনের উসূল কিভাবে নিয়েছেন। এই উসূলই সমস্ত হানাফি ফকিহদের উসূল। তাদের কাছেও যখন নতুন মাস'আলা আসবে তারাও একই ভাবে মাসায়েলের সমাধান বের করেন ।
এখন কথা হলো ইমাম সাহেব রহঃ উক্তির ' হাদিস যখন সহীহ পাবে সেটিই আমার মাজহাব' এর উদ্দেশ্য কি?  তিনি কি তাঁর মাজহাব বলতে বুখারী, মুসলিমকেই বুঝিয়েছেন?

বলে রাখি ইমাম সাহেব রহঃ বক্তব্যকে চরম জালিয়াতি করা হয়েছে। ইমাম সাহেব রহঃ এর উক্তি 'ইযা সাহহাল হাদিস ফাহুয়া মাজহাবী' এর আসল অর্থ হলো 'যখন হাদীস সহীহ হয়, সেটিই আমার মাযহাব।' (হাশিয়ায়ে শামী)
এই কথা দ্বারা দুটি উদ্দেশ্য বহন করে।
১ -  তিনি তাঁর যগ্য ছাত্র, যারাও মুজতাহিদ ছিলেন তাদেরকে বুঝিয়েছেন 'সহীহ হাদিসই আমার মাজহাব' সুতরাং তোমরাও যখন সমাধান বের করবে সহিহ হাদিসকেই অগ্রাধিকার দেবে।
এবিষয়ে  সয়ং ফতওয়ায়ে শামীর লেখক স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন,
'এই বাক্যটি সম্বোধিত ব্যক্তি হলো কেবলমাত্র মুজতাহিদ ইমামগণ। অতএব যার-তার জন্য এই উক্তিটি পুঁজি বানিয়ে রিচার্স-গবেষণায় নামা অনধিকার চর্চা বলে গণ্য হবে।'
ইমাম নববী রহ. ‘শরহুল মুহাযযাব’ গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেছেন, এই কথাটি ‘মুতাবাহহির’ তথা বিদগ্ধ আলেম-উলামাদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে।

২- তিনি পরিষ্কার কন্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, আমার মাজহাবের ভিত্তি সহিহ হাদিসের উপরই,এর খিলাফ নয়।
যদিও বর্তমানের আহলে হাদিসদের একদল আলিম, ইমাম সাহেবের বক্তব্য দ্বারা বুখারী  মুসলিম ও তাদের মতবাদের সাথে মিশে যাওয়া সহীহ হাদিসকেই বুঝিয়ে থাকে তাতে আমাদের কিছু করার নাই বরং তাদেরই দূর্ভাগ্য বলতে পারি। কেন দূর্ভাগ্য!  কারন ইমাম সাহেবের উক্ত কথা যদি কুতুবে সিত্তাহ অর্থাৎ হাদিসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের উপর ব্যাবহার করা হয় তাহলে কোন কিতাব বাতিল হবে জানিনা তবে বুখারী তো বাতিল হয়েই যায়।
যদি ইমাম সাহেব রহঃ এর সহীহ হাদিস আমার মাজহাব কথার উপর আমল করে বুখারী, মুসলিম মানতে হয়, তাহলে অবশ্যই ইমাম সাহেবের সহীহ হাদিসের উসূলও মানতে বাধ্য হতে হবে। অবশ্যই ইমাম সাহেব রহঃ যেই সহীহ হাদিস মান্য করার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন সেটা অবশ্যই তাঁর স্বীয় উসূল অনুযায়ী ছিলো। আমরা যারা এবিষয়ে পড়বো তারা অবশ্যই জানবো প্রত্যেক মুহাদ্দিস হাদিস গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে উসূলের ব্যাবহার করে থাকেন। একে অপরের নীতিমালার মধ্যে পার্থক্যও থাকে।
 ইমাম আবু হানিফা রহ. শর্ত দিয়েছেন, বর্ণনাকারী হাদিস শোনার সময় থেকে অন্যের নিকট পৌঁছানো পর্যন্ত তা মুখস্থ রাখা জরুরি। এবং মধ্যবর্তী সময়ে সে হাদিসটি কখনও ভুলবে না।
(আসারুল হাদীসিস শরীফ ফী ইখতিলাফিল আয়িম্মাতিল ফুকাহা - শায়েখ আওয়ামাহ)
সকলেই জানেন এই শর্ত অত্যন্ত কঠিন শর্ত তাই বুখারী মুসলিম সহ অনেক মুহাদ্দিস এই শর্ত নিতে পারেননি।
তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে ইমাম সাহেব রহঃ এর উক্তি যদি নেন তাহলে তাঁর শর্তও নিতে হবে আর তাঁর শর্ত নিয়ে বুখারী, মুসলিমের কোন হাদিস ধরবেন আর কোন হাদিস ছাড়বেন??
পরিশেষে কথা হলো হানাফী মাজহাবের পক্ষে শুধুমাত্র কুতুবে সিত্তাহতেই দলিল খোঁজা বোকামি বৈ কিছুইনা কারন প্রীয় রাসূল সাঃ এর সুন্নাহ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে ছড়িয়ে রয়েছে আর সেগুলির জমা করার মাধ্যমেই বিভিন্ন সমাধান দেওয়া হয়েছে মাজহাবে। আর যদি মেনেই নিই সহীহ হাদিস মানলেই ইমাম আবু হানিফা রহঃ মাজহাব মানা হবে তাহলে চরম ভুল হবে কারণ হাদিস সহীহ হলেই আমলযোগ্য এমনটা নয়। এমন অনেক হাদিস আছে যেটা সহীহ কিন্তু তার উপর উম্মাহের আমল নাই অথবা তা রহিত হয়েগেছে।

আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা আমাদের সঠিক বুঝার তাওফিক দিন

Comments

Popular posts from this blog

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ