তাকলীদের প্রয়োজনীয়তা কেন?
উপরোল্লিখিত আলোচনা দ্বারা আশা করি আপনাদের সামনে তাকলীদের প্রকৃতি বা স্বরূপ ফুটে উঠেছে। এ পর্যায়ে তাকলীদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ أَبِي أُوَيْسٍ، قَالَ: حَدَّثَنِي مَالِكٌ، عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ العَاصِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ العِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ العِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ العِلْمَ بِقَبْضِ العُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا، فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا (رَوَاه الْبُخَارِىُّ فِىْ بَابٌ: كَيْفَ يُقْبَضُ العِلْمُ)
হাদীস নং- ২৩ : আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ রা. বলেন, আমি রসূলুল্লাহ স.কে বলতে শুনেছি: তিনি ইরশাদ করেন: আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তর থেকে ইলম ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে দ্বীনী ইলম উঠিয়ে নিবেন না। বরং উলামায়ে কিরামের বিয়োগের মাধ্যমে ইলম দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিবেন। এমনকি যখন তিনি আর কোন আলিম অবশিষ্ট রাখবেন না তখন মানুষ মূর্খদেরকে নেতা বানিয়ে নিবে এবং তাদের নিকটে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হবে। তারা না জেনেই ফতওয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরাও গোমরাহ হবে, অন্যদেরকেও গোমরাহ করবে। (বুখারী: ১০১)
সারসংক্ষেপ : এ হাদীস থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝা যায়:
এক. উম্মাত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত (ক) সাধারণ মানুষ, যারা অন্যদের থেকে মাসআলা জিজ্ঞেস করে আমল করে। (খ) সেসব মানুষ যারা মানুষের ধর্মীয় সমস্যার সমাধান করে। এ দুই শ্রেণীর লোকের মধ্যে সাধারণ জনতার প্রতি রসূলুল্লাহ স.-এর নির্দেশ রয়েছে অযোগ্য লোকের নিকটে মাসআলা জিজ্ঞেস না করে বরং বিজ্ঞ মানুষের থেকে মাসআলা জেনে নিবে। যেন অযোগ্য লোকের ভুল মাসআলা তাকে গোমরাহ করতে না পারে। আর ফতওয়া প্রদানকারীগণের প্রতি রসূলুল্লাহ স.-এর নির্দেশ হলো: কুরআন-হাদীসের সম্যক জ্ঞান অর্জন ব্যতীত যেন কাউকে ফতওয়া প্রদান না করে। এ নিয়ম মেনে চললে উভয় শ্রেণী গোমরাহী থেকে বেঁচে যাবে। আর এটা অমান্য করলে উভয় শ্রেণীই গোমরাহীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
দুই. এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, গোমরাহীর মূল কারণ হলো কুরআন-হাদীসের সম্যক জ্ঞান অর্জন করা ব্যতীত কাউকে ফতওয়া প্রদান করা। আর এ জাতীয় অজ্ঞদের নিকটে মাসআলা জিজ্ঞেস করা তাদের গোমরাহীকে আরও উৎসাহিত করে।
তিন. জনসাধারণ যাদের নিকটে মাসআলা জিজ্ঞেস করে গোমরাহীর পথ ধরে, তারা নিশ্চয় কিছু জ্ঞান রাখে। তা না হলে মানুষ তাদের নিকটে মাসআলা জিজ্ঞেস করত না। কারণ, কেউ কারও নিকটে কোন বিষয়ের মাসআলা বা ফতওয়া তখনই জানতে চায় যখন তাকে নিজের থেকে বেশী জ্ঞানী মনে করে। অথচ রসূলুল্লাহ স. এ অল্প জ্ঞানী নেতাদেরকেও মূর্খ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিশুদ্ধ মাসআলা বলার মতো সম্যক জ্ঞান না থাকলে তারা মৌলিকভাবে মূর্খদের দলভুক্ত। সুতরাং কুরআন-হাদীসের অনুবাদ পড়ে বা কিছু আয়াত-হাদীস মুখস্থ করে কেউ যেন নিজেকে ফতওয়া দানের আসনে সমাসীন মনে না করে। তাহলে এটা হবে আরেকটি মূর্খতা।
চার. অজ্ঞতার কারণে অপরের মাসআলার ভুল জবাব দেয়া যেমন গোমরাহী,
অজ্ঞতা সত্ত্বেও নিজের মাসআলার সমাধান নিজে করা বা করতে যাওয়াও অনুরূপ গোমরাহী। উল্লিখিত গোমরাহীর দু’টি কারণ থেকে বাঁচার উপায় হলো পর্যাপ্ত ইলম শিক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞ আলিম ও মুজতাহিদ হয়ে যাওয়া। তাহলে তার ইজতিহাদ বা গবেষণা গোমরাহীর কারণ হবে না; বরং হিদায়াতের কারণ হবে। আর একান্ত যদি কেউ বিজ্ঞ আলিম ও মুজতাহিদ হতে না পারে তাহলে গোমরাহী থেকে বেঁচে থাকার উপায় হলো কোন বড় আলিমের নিকট থেকে ফতওয়া নিয়ে সে অনুযায়ী চলা।
হাদীসের ব্যাখ্যা শেষে এবার আমরা মূল আলোচনায় ফিরে আসি। রসূলুল্লাহ স. যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের নবী। তাই তাঁর বাণীও কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের পথনির্দেশ। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের মধ্যে বিজ্ঞ আলিম ও মুজতাহিদগণের জন্য গোমরাহী থেকে বাঁচার পন্থা হলো সরাসরি কুরআন-হাদীস বুঝে তদানুযায়ী আমল করা। আর যারা সেই পর্যায়ের নয় তাদের জন্য গোমরাহী থেকে বাঁচার পন্থা হলো বিজ্ঞ আলিম ও মুজতাহিদগণের নিকট থেকে কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা জেনে তদানুযায়ী আমল করা। কেউ যদি গোমরাহী থেকে বাঁচার উল্লিখিত পন্থাদু’টির কোনটিই অবলম্বন না করে অর্থাৎ, বিজ্ঞ আলিম ও মুজতাহিদ হলো না, আবার মূর্খতা থাকা সত্ত্বেও কোন বিজ্ঞজনকে জিজ্ঞেস করলো না; বরং মুজতাহিদ সেজে গবেষণার মতো দুঃসাহসী কাজে আত্মনিয়োগ করলো, তাহলে নিশ্চয় সে হাদীসের ভাষ্য মোতাবেক গোমরাহদের দলভুক্ত হলো। সুতরাং হিদায়াতের ওপর থাকার জন্য প্রথম প্রয়োজন হলো বিজ্ঞ আলিম মুজতাহিদ হওয়া। অন্যথায় মুজতাহিদের থেকে জেনে নিয়ে পথ চলা। এই শেষোক্ত পদ্ধতির নামই তাকলীদ যার প্রয়োজনীয়তা হাদীসের ভাষ্য দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে তাকলীদ জনসাধারণের জন্য গোমরাহী থেকে বেঁচে হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার একমাত্র মাধ্যম।
Comments
Post a Comment