ফুরফুরা শরীফের ইতিবৃত্ত







 আল্লামা রুহুল আমিন রহমাতুল্লাহ আলাইহি গোলাম সালমান আব্বাসী থেকে বর্ণনা করেন ফুরফুরা এই শব্দ উৎপন্ন হইছে "ফার্রে-ফারহা"শব্দ থেকে। যার অর্থ যাক জমোকময় আনন্দ।যাকে পূর্বে বালিয়া বাসন্তী বর্তমানে ফুরফুরা শরীফ নামে ডাকা হয়।বালিয়া বাসন্তীর বিজয় সংবাদ দিল্লির বাদশা অবগত হন এবং শহীদানের মৃত্যু সংবাদে খুব দুঃখিত হলেন তারপর বাদশা বঙ্গদেশের বঙ্গদেশের নবাব এর নিকট আদেশ দেন "যে সকল মুসলমান বালিয়া বাসন্তী জয় করে ফুরফুরা শরীফে বসতি স্থাপন করেছেন তাহাদিগকে জায়গীর প্রদান করুন" নবাব মুসলমানদেরকে নিষ্কর জমি এবং অল্প করে জমি প্রদান করেন।উহার মালিকগণ বর্তমানে আইমাদার পরিচিত বাদশা যখন কয়েকটি কারণে জায়গীর প্রদান করতেন তার মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হলো, এক তৎকালীন সুলতান এর বিশ্বস্ত আমাত্ববোর্গের মধ্যযারা সম্মানীয় পদে ছিলেন তাদের প্রত্যেককে বাদশা জায়গীর ব্যবস্থা করেছিলেন, তারা সবসময়ই বাদশা এর কথা মেনে চলতেন। বেতনভোগী কর্মচারীদের অন্যরা ছোট-বড় জায়গীর ভোগ করতেন।দুই বিচক্ষণ মানুষদের যথাযোগ্য স্বীকৃতি স্বরূপ বাদশা উপযুক্ত জায়গীর ব্যবস্থা করতেন তাদের উপর বাদশার কিছু শর্ত থাকতো, সাধারণত এসায়েতে ইসলাম, পীর- মুরিদ,মসজিদ হেফাজত, মাদ্রাসা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।মুসলমান সুলতানদের মধ্যে অধিকাংশ সুলতানদের কেবলমাত্র রাজ্য জয় করার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং দ্বীনের প্রচার প্রসার ঘটানোর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই পার্থিব জগতের ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে যেসব পীর বুজুর্গ দরবেশ সর্বদা ধর্মের কাজে নিয়োজিত ছিলেন,নিরুপায় হয়ে বাদশা সেই সব বুযুর্গদের শরণাপন্ন হয়েছেন নিছক দিন ও জনকল্যাণে সেই সব বুজুর্গ তাদের সাহায্য করেছেন। কিন্তু রাজ্য ও পদের মোহ তাদেরকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ঐতিহাসিক ফুরফুরা শরীফের অতীতের স্মৃতি মন করলে আমরা জানতে পারি ফুরফুরা শরীফ ফুরফুরার পার্শ্ববর্তী আয়মদর গণ এই দেশের অধিবাসী ছিলেন না।তারা বিদেশ থেকে এসেছিলেন। তাদের বংশের ধারা(family tradition) বঙ্গের অধুনা মুসলিম থেকে স্বতন্ত্র।আইমাদার গনের  জীবনযাত্রা অন্যান্য গ্রামবাসীদের সাথে একাত্ম হয়ে গেলেও তাদের আচার-আচরণ,পরিবেশ, রুচি, ভাষা,ভাবধারার স্বতন্ত্র ইঙ্গিত বহন করে তাদের খেয়াল এখনো পূর্বের ন্যায় বিদ্যমান।তাদের পর্দা পুষিদা এখনো প্রশংসনীয়, প্রাক প্রণালী সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারায়। আমির গরীব নির্বিশেষে সেই বৈঠকখানা এখনও অতীত দিনের বংশীয় ভাবধারার নমুনা বহন করছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফুরফুরার সর্ণ অধ্যয় সূচিত করেন মোজাদ্দেদ জামান আবুক্কার সিদ্দিকী (রহ:)।ফুরফুরা নামের স্বার্থক রূপায়ণে তিনি সর্বাধিক অবদান রাখেন।তখনকার ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র গুলি পরিচালিত হতো "লা - ক্ষেরাজ"সম্পত্তির আয় থেকে, বেদনাদয়ক ইতিহাসের একটু পরিচয় জানতে পারলে পরবর্তী কালে মোজাদ্দেদ জামান আবুক্কার সিদ্দিকী (রহ:) কর্তৃক প্রতিষ্ঠান তৈরির অসীম গুরুত্ব অনুধাবন সহজ হবে।১৭৯৩ সালে কর্ণয়ালিশের চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের ফলে মুসলিম জমিদারগণ পরিণীত হলো কৃষি মজুরিতে। তথা কথিত ধুরন্ধর তহসিলদারের হাত সাফাইতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিশেষ অনুগ্রহে কতিপয় অমুসলিম জমিদার বেনে গেলেন।এরপর ১৮২৮ সালে low of Resumeption এলোপূর্ণ দখল আইন।এই আইন বলে উলামা,পীর দরবেশ গনের লা -খেরাজসম্পত্তি গুলি তল্পিবাহক জমিদারদের কুক্ষিগত করে দিল ইংরেজ সরকার তখন যে সব দিনই প্রতিষ্ঠানগুলি লাখেরাজ সম্পত্তিএর আয় থেকে চলতো সেগুলি "পূর্ণ দখল আইন"এর ফলে বন্ধ হয়ে গেলো। তবুও ইংরেজদের চক্রান্ত শেষ হলো না,বরং শুরু হলো নতুন চক্রান্ত। উইলিয়াম হান্টার ১৮৭১ সালে "The Indian musilmans" গ্রন্থে লিখেছেন "ভারত সরকারএর দেশরক্ষা বিভাগেরsecretary মিস্টার বেইলি বলেছেন আমরা এমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছি,আমাদের বিবেচনায় যত ভালো হোক না কেনমুসলমান সমাজ সাবধানে দূরে অবস্থান করছে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই কারণ এই শিক্ষা ব্যবস্থা মুসলমানদের শিক্ষা সংস্কৃতি এবং মানসিকতা সম্পূর্ণ বিপরীত। এই শিক্ষা তাদের নীতি নৈতিকতা ও ধর্মীয় ভাবের মান রক্ষা করতে পারেনা"উইলিয়াম হান্টার অন্যত্র লিখেছেন- "রাতারাতি মুসলমানদের করার কাঙ্গাল বানিয়ে দিয়েছে"।মুসলিম সাম্রারটদের ভাষা ছিল ফার্সি,১৮৩৬সালে সে পথ রুদ্ধ।ফলেচাকরি ক্ষেত্রে মুসলমানরা বঞ্চিত হল। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হল।কেমন ছিল সে শিক্ষা উইলিয়াম হান্টারএর ভাষায়"A system exclusively adapted to the Hindu"অর্থাৎ এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা যা কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্য উপযুক্ত ছিল। মুহতারাম দেওয়ান মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেন তর্কবাগীশ "ইনসানিয়াত" পুস্তকে বাংলার শিক্ষিত সম্বন্ধে সুন্দর একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন।তৎকালীন বাংলার মোট জনসংখ্যা ৪৬৫৪৪৮৭০ জন তার মধ্যে 44870 জন,তার মধ্যে খিষ্টান ৪৪৮৭০জন,হিন্দু ২১০০০০০০জনএবং মুসলমান ২৫৫০০০০০ জন।শিক্ষার হার ১৯২৬-২৭ সালের রিপোর্ট থেকে জানাজায় যে,নিম্ন প্রাইমারীতে হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা শতকরা ৪৩ জন,মুসলমান শতকরা ৫৭ জন, উচ্চ প্রাইমারীতে হিন্দু শতকরা ৬১ জন,মুসলমান শতকরা ৩৯ জন,মধ্যশিক্ষায় হিন্দু শতকরা ৮০ জন,মুসলমান শতকরা ২০ জন, হাই স্কুলে হিন্দু শতকরা ৮৫ জন,মুসলমান শতকরা ১৫ জন, আর্ট কলেজে হিন্দু শতকরা ৮৬ জন,মুসলমান শতকরা ১৪ জন,টেকনিকাল কলেজে হিন্দু শতকরা ৭৮ জন,মুসলমান শতকরা ২২ জন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে হিন্দু শতকরা ৮৪ জন,মুসলমান শতকরা ১০ জন,অন্যান্য ৫ জন,মেডিক্যাল কলেজে হিন্দু শতকরা ৮৯ জন,মুসলমান শতকরা ৯ জন, অন্যান্য ২ জন।হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত শিক্ষার হার ছিল পুরুষ শতকরা ৯ জন,মহিলা শতকরা পৌনে দুইজন।এ হেন যুব সন্ধিক্ষণে আবু বক্কার সিদ্দিকী রহমাতুল্লা আলাইহি মুসলমানদের অধঃপতনের কালে সক্রিয় সহযোগিতায় ও আদেশে বাংলা- আসামে অনুমান দ্বিসহস্রাধিক মাদ্রাসা ও মসজিদ স্থাপন করেন। তিনি শিক্ষার প্রচার প্রসারের জন্য ফুরফুরা শরীফে স্বীয় পীর এর এর নামে একটি মাদ্রাসা তৈরি করেন, যার নাম হল "মাদ্রাসায় ফাতেহিয়া ফুরফুরা শরীফ" বঙ্গ আসামে সম্ভবত এটাই প্রথম খারিজি মাদ্রাসা।  পরবর্তী পর্যায়ে পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়। যথা ফুরফুরা ফাতেহিয়া খারিজি মাদ্রাসা, ফুরফুরা ফাতেহিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা,ফুরফুরা হাই মাদ্রাসা ফুরফুরা, হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও ওয়েস্ট বেঙ্গল সিদ্দিকিয়া গার্লস মাদরাসা। ১৯০২ সালে আলিয়া নিসাব পর্যায় ভুক্ত করে "ফুরফুরা ফাতেহিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা"নামকরণ করেন। ১৯০৮ সালে ইংরেজ সরকার মাসিক দুইশত টাকা সাহায্য মঞ্জুর করেন। এটাই সম্ভবত পল্লী বাংলায় প্রথম সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত মাদ্রাসা জুনিয়র মাদ্রাসা।১৯১৫ সালে নিউ স্কিম মাদ্রসা তৈরি করেন। তিনি সামাজিক অপরাধ দূরীকরণের লক্ষে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। দাতব্য প্রতিষ্ঠান,এতিম খানা এবং বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।তিনি একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন।তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমে দূর করতে পারবেন সমাজের ক্ষতিকারক দিকগুলো। তাই তিনি অনেক মাদ্রাসা স্কুল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। তিনি নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য ফুরফুরা শরীফে মেয়েদের জন্য স্কুল তৈরি করেন। তিনি সবসময় বলতেন যে " একজন লেখকের কলম শহীদের থেকেও উত্তম"তাই তিনি অনেক ইসলামিক পত্রিকা এবং খবরের প্রত্রিকা কে পৃষঠপোষকতা করেন।তিনি একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন।তার অনুসারীরা কেবলমাত্র মুসলমানরা ছিলেন না বরং বিভিন্ন গত্র ও ধর্মের মানুষ ছিলেন।তার কার্যক্রম বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবী কর্তৃক প্রশংসিত ছিল।দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান থেকে প্রকাশিত "দি মুসলিম ডাইজেস্ট"এ অবুক্কার সিদ্দিক সম্বন্ধে বলেছে "illustrious,religious leader fearless,god intoxicated and selfless as a preacher ,he would never attack other religions and endeared himself to people from other communities and castes"১৯৩৯ সালের ১৭ ই মার্চ তিনি তাঁর পাঁচ পূত্র রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন,যাহারা প্রত্যেকেই ইসলামিক ধর্ম তত্ত্ব বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।
তথ্যসূত্র:১। "দাদা হুজুর পীর কেবলা (রহ:)এর বিস্তারিত জীবনী"।অল্লামা রুহুল আমীন (রহ:)২।"The Indian musilmans".w.w hunter.৩।"হাকিকাতে ইনসানিয়াত"।মহা: ইব্রাহিম তর্কবাগীশ ৪।সৈয়দ আজমাত হুসেন সম্পাদিত "মাসিক নেদায়ে ইসলাম"(এপ্রিল ২০১৭)৫।The Indian express(৩রা মার্চ,২০০৬)৬।"The Muslim digest"(from darban,s.africa)

Comments

Popular posts from this blog

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?