জেরুসালেম ফিলিস্তিনের রাজধানী আলআকসা আমাদের লালরেখা
- হে গাঁজার বীর শহীদেরা, এ লেখা নিবেদন করছি তোমাদেরই ! -
এক.
সূচনাকথা
ফিলিস্তিন কোনো সাধারণ নগরী নয়। ফিলিস্তিন একটি পুণ্যভূমি। নবী-রাসূলদের পরশধন্য— সূতিকাগার। সর্বযুগে সর্বকালে এখানে আল্লাহর প্রতি সর্বানুগত্য অলঙ্ঘিত ছিলো। এখানে আছে মুসলমানদের প্রথম কিবলা আলআকসা। এখানে আছে আলআকসার শহর আলকুদস (জেরুসালেম)। আলআকসার মহাবরকতে আলকুদসসহ সারা ফিলিস্তিন বরকতঘেরা। তার আশপাশও বরকতঘেরা। আকাশ থেকে এখানে নিরত বরকত ঝরে। বরকতে বরকতে সবকিছু সিক্ত হয়। ধন্য হয়। এখানে ছিলো নবুওতের নূরের তাজাল্লি। এখনো আছে ঘুমিয়ে থাকা সেই তাজাল্লির বরকত-ঝলক। এখানে সব সময় প্রবল থাকে হক। বাতিলের এখানে কোনো জায়গা নেই। বাতিল মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ার অপচেষ্টা করে মাত্র। অনুপ্রবেশের কালো চাদরে নিজেকে ঢেকে রাখে দুরভিসন্ধিঘেরা স্বল্প মেয়াদি অবস্থানে। হঠাৎ হঠাৎ দল ভারী করে। চিৎকার জুড়ে দেয়। হইচই বাধিয়ে দেয়। এ সবই স্বল্পস্থায়ী। সকালের ‘ঝিলমিল’ কুয়াশা। কিংবা একটু ধোঁয়াশা। সূর্য উঠলে নেই হয়ে যায়। চিহ্নহীন হয়ে যায়। এ সূর্য সত্যের সূর্য—পুণ্যভূমি ফিলিস্তিনের স্থায়ী উত্তরাধিকার।
এখানে কেউ আঘাত করতে পারে না। আঘাত করলে রক্ত-প্রতিরোধ দানা বাঁধে। শহীদি-প্রতিরোধ রুখে দাঁড়ায়। লাল লাল চোখের রাঙানি অপশক্তিকে তেড়ে বেড়ায়। শিশুর হাতে উঠে আসে— পাথর। গোলাইল। যায়তুনের ডাল। শুষ্ক ত্বীন ফলের ‘গুলি’।
ফিলিস্তিনের বন্ধু অনেক। কিছু বন্ধু—সুদিনেরও বন্ধু, দুর্দিনেরও। কিছু বন্ধু— শুধু সুদিনের। দুর্দিনে এদের কাছে যাওয়া যায় না। সুদিনের-দুর্দিনের বন্ধুরা হকের বন্ধু। অন্যটি মুনাফিক বন্ধু। মুনাফিকেরা তলে তলে সাহায্য করে ফিলিস্তিনের জাত দুশমনকে। উপরে উপরে মায়াকান্না কাঁদে ফিলিস্তিনের জন্যে। এ কান্না ঢাকা থাকে কুটিল প্রতারণার চাদরে।
প্রিয় পাঠক, সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে হক ও বাতিলের লড়াইয়ের একটি ছোট্ট দৃশ্য থাকবে আপনার সামনে। থাকবে এই বন্ধু-অবন্ধুর আলোচনা। থাকবে ফিলিস্তিনের একটি খ-চিত্র। আরও থাকবে ইহুদিদের অভিশপ্ত দখল-ইতিহাসের টুকরো কথা এবং প্রতিরোধে ফিলিস্তিনী দামালদের জ্বলে ওঠার রক্তঘন ইন্তিফাদার লালচিত্র। থাকবে একটু আক্ষেপ। শেষে থাকবে সোনালি আশাবাদ। এসব নিয়েই ফিলিস্তিনের ভালোবাসায় একটি ছোট্ট আয়োজন।
দুই.
একগুচ্ছ লালনীল শিরোনাম
পুণ্যভূমি এই ফিলিস্তিনেই একদিন হামলে পড়লো ইহুদিরা। সেই অভিশপ্ত দিনটা ছিলো ১৪ই মে, ১৯৪৮ সাল। চললো ওদের ধ্বংসমেশিনের তা-বলীলা। পাগলা হাতির মতো ‘হাগানাহ-সন্ত্রাস’। (অমুসলিম জাতির চিরবন্ধু) জাতিসঙ্ঘ এই আগুনে ঘি ঢেলে দিলো। এই দখলকে বৈধতা দিলো। এই অন্যায় ধ্বংসলীলাকে ‘হ্যাঁ’ বললো। বাড়তে লাগলো ৫৫ । কমতে লাগলো ৪৫ । ৬৭ তে ইসরাঈল হয়ে গেলো মানচিত্রখেকো। গিলতে লাগলো মানচিত্র। খাবলে খাবলে খেতে লাগলো ফিলিস্তিনের পবিত্র গোশত। নাপাক মুখে। অভিশপ্ত ছোবলে।
একদিন বীর গাজার জাবালিয়ায় ফিলিস্তিনের রক্ত বইলো। জবাবে জ্বলে উঠলো দামালেরা। হাতে তুলে নিলো পাথর আর গোলাইল। একেকটি শুক্রবার যেনো একেকটি হিত্তিন। ৮৭ থেকে ৯৩। এলো— ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’র দিন—ওসলোদিবস । আবারো ইন্তিফাদা। চলছে হত্যাযজ্ঞ। চলছে প্রতিশ্রুতি। এবং চুক্তি। সমানতালে চলছে প্রতিশ্রুতি ভাঙা। চুক্তিভাঙা। সে এক রক্তের ইতিহাস। লালবর্ণের কবিতা। নীলবর্ণের শোকগাথা। এসব পেরিয়ে পেরিয়ে ফিলিস্তিন যখন দখলদারিত্বের ৭০-এর দোরগোড়ায়, তখনই এলো চূড়ান্ত স্বপ্নভাঙার কালো দিনটি। এলো ট্রাম্পের কালো ঘোষণা— জেরুজালেম ইসরাঈলের রাজধানী!
একটু খুলে বলি। এতোক্ষণ বলছিলাম শুধু শিরোনাম।
কিন্তু সব কথা কি খুলে বলা যাবে? ছোট্ট এই পরিসরে?
তবুও কিছু কিছু কথা, কিছু কিছু শব্দে, লাল-নীল বর্ণে।
তিন.
ইহুদি ও আমেরিকা এবং আমরা
আমেরিকা ও ইহুদিদের সম্পর্ক এখন প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক। অথবা বলুন, ইহুদি ‘রাষ্ট্র’ ইসরাঈল এখন আমেরিকার বরপুত্র। নাদুশ-নুদুশ আহ্লাদে শাহযাদা। আমেরিকা তার কোনো আবদার ও বায়না অপূর্ণ রাখে না। এই ইসরাঈলের একটি আবদার ছিলো— আলকুদস নিজেদের রাজধানী করা। এই আবদারপূরণে আমেরিকা একটু গড়িমসি করছিলো। আজ না কাল বলে বলে কালক্ষেপণ করছিলো। বরপুত্র বা শাহযাদা ইসরাঈল এতে খুব গাল ফুলিয়ে রাগ রাগ অপেক্ষা করছিলো। অবশেষে ট্রাম্প এলেন—তাকে আনা হলো। বরপুত্রের মুখে হাসি, ঠোঁটে তৃপ্তি। ইসরাঈলের কাছে ট্রাম্প কেনো এতো প্রিয়? বোঝা গেলো এর রহস্য ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ সালের এই কালদিনে। এই দিন আমেরিকা সদর্প ঘোষণা দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে— জেরুসালেম শুধু ইহুদিদের। পূর্ব-পশ্চিম কোনো ভাগাভাগি নেই। দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক কোনো দরকষাকষিও আর চলবে না। সমগ্র জেরুসালেম ইসরাঈলের রাজধানী। অচিরেই আমেরিকা দূতাবাস সরাবে তেলআবিব থেকে নতুন রাজধানী জেরুসালেমে!
কী প্রতিক্রিয়া হলো ফিলিস্তিনে? বিশে^? মুসলিম বিশে^? সে কথায় একটু পরে আসছি। তার আগে আমেরিকা ও দখলদারদের একটু বলতে চাই—
ফিলিস্তিনীরা এবং আমরা এই ঘোষণা মানি না। ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। এই ঘোষণা প্রকাশ্যে আমাদের লালরেখা অতিক্রমের ঘোষণা। লালরেখা অতিক্রম করে যাওয়া মানে যুদ্ধ ঘোষণা করা। আলআকসা আমাদের প্রথম কিবলা। প্রথম কিবলাও আমাদের লালরেখা। আলআকসার শহর—জেরুসালেমও আমাদের লালরেখা। একদল দখলদার তা কেড়ে নেবে, অবৈধ রাষ্ট্রের রাজধানী বানাবে এবং এখানে অবস্থিত আলআকসাকে অসম্মান করবে, যখন-তখন ইচ্ছেমতো অন্যায় বিধি-নিষেধ আরোপ করবে, জুমা পড়তে বাধা দেবে—এ আমরা হতে দিতে পারি না। অসম্ভব। আমাদের প্রথম কিবলার অসম্মান হলে আমরা সহ্য করবো না। আমাদের জেরুসালেম নাপাক দখলদারদের কবলে পড়ে দলিত হতে দেবো না। লালরেখা অতিক্রমকারীদের আমরা ক্ষমা করবো না। কেউ আমাদের প্রথম কিবলায় আঘাত করতে এলে আমরা জ্বলে উঠবো। ইন্তিফাদার ‘জ্বালানোআগুন’ চোখে নিয়ে শত্রুর দিকে তাকাবো, ভস্ম করে দেবো। হাতে অস্ত্র না থাকলে গোলাইল নেবো। পাথর কুড়িয়ে ভেতরের পকেটে রাখবো, বাইরের পকেটে রাখবো, স্কুলব্যাগে রাখবো, পতাকায় মুড়িয়ে রাখবো গাছের নিচের কোনো ফাঁক-ফোকরে। তারপর জ্বলে উঠবো। জ্বলে উঠে ট্যাংকের মুখোমুখি হবো। সাঁজোয়াযানের সামনে বুক পেতে দাঁড়াবো।
বুলেট-গুলির ভয় আমরা অনেক আগেই ভুলে গেছি। কতো বুলেট আমাদের ভাইদের বুক একের পর এক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। বুকের তাজা রক্তে সেই বুলেট ‘লাল মেখে’ বেরিয়ে গেছে। কই, আমরা তো ভয় পাই নি! আলআকসার জন্যে, জেরুসালেমের জন্যে, ফিলিস্তিনের জন্যে রক্ত দিতে আমরা ভালোবাসি। আমরা যাকে ভালোবাসি তার জন্যেই রক্ত দিই! দুই দুইটি ইন্তিফাদায় আমরা প্রমাণ করেছি, আমাদের রক্তের কোনো অভাব নেই! তৃতীয় (আলআকসা) ইন্তিফাদায় তাহলে কেনো আমাদের রক্তশূন্যতা দেখা দেবে?!
ইচ্ছে হলে জিজ্ঞাসা করো ওই আকাশ আর এই জমিনকে— বুকের তাজা তাজা রক্তের কতো নাজরানা আমরা ঢেলে ঢেলে দিয়েছি! এখন আবার হবে ইন্তিফাদা। আরও বড়। আরও স্পৃহাময়।
এই তৃতীয় ইন্তিফাদা—
আলআকসা ও জেরুসালেম রক্ষা করার ইন্তিফাদা।
এর জন্যে রক্ত লাগলে অকাতরে আমরা রক্ত দেবো।
রক্তে রক্তে সব ভাসিয়ে দেবো।
অন্যায় ভাসিয়ে দেবো।
জুলুম ভাসিয়ে দেবো।
এই ইন্তিফাদায় পবিত্র জেরুসালেমের ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি হেফাজত করার শপথ নেবো! ইহুদিদের আধুনিক মারণাস্ত্রের ‘সঙ্কট’ আছে, কিন্তু আমাদের বুকের কোনো অভাব নেই। গুলি চালাতে চালাতে একসময় ওদের গুলি শেষ হয়ে যাবে, অস্ত্র শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের বুক শেষ হবে না। আমাদের বুকে রক্তেরও কোনো ঘাটতি নেই। বুকের পরে বুক পেতে এই-যে দঁাঁড়িয়ে আছি আমরা। ছড়িয়ে আছি সারা ফিলিস্তিনে, সারা আরবে, সারা এশিয়ায়। ... আমাদের বুকের রক্তে একটি জীবাণু আছে, এ জীবাণুর নাম— বীরত্ব। শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ—সবার শরীরে লুকিয়ে আছে এ বীরত্ব। এ বীরত্বের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে দূর অতীতের দুর্ধর্ষ দুশমন! বর্তমানের দুশমন কি আরও বেশি দুর্ধর্ষ?! কুচ পরোয়া নেহি! গুলি চালাও, যতো পারো! কতো আর গুলি চালাবে? কতো আর মারবে?
মজার ব্যাপার কী জানো, তোমরা মারলে আমরা মরি না; বরং শহীদ হয়ে যাই! সবুজ পাখি হয়ে যাই—জান্নাতের সবুজ পাখি!
কী মজা! তোমরা মেরে যতো খুশি হও, আমরা মরে তারচেয়ে অনেক বেশি খুশি হই!
আমরা তাই রক্ত দিতে চিরলালায়িত!
তোমরা অবাক হও—
কেমনে আমরা গোলাইল আর পাথর নিয়ে মুখোমুখি হই—তোমাদের সাঁজোয়াযান আর ট্যাংকের! হ্যাঁ, গোলাইল হাতেই আমরা সিংহ!
উমর বিন খাত্তাব!
সালাহুদ্দীন আইয়ূবী!
তাঁরা ছিলেন আলআকসার দূর অতীতের মহাবীর!
আমরা তাঁদের উত্তরসূরি!
নিকট অতীতের খুদে বীর!
তাঁরাই আমাদের চেতনা!
আমরাই তাঁদের স্বপ্ন-আশা!
পাথর হাতেই আমরা আলী হায়দারের মতো মহাহুঙ্কার!
প্রিয় খালিদের মতো দুর্বিনীত অপরাজেয়। খাপখোলা তলোয়ার।
এই জুলুমবাজ ইহুদি অস্ত্রধারীরা, শোনো, আমরা তোমাদের মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র হাতে বানর বানর চোখে তাকাই না—ভীতি ঝরাই না!
সুতরাং হে ইহুদিরা, সাবধান!
হে ইহুদিদের বন্ধু-জোট, সাবধান!
হে নীল-ফুরাতের বিলাসী স্বপ্নবাজেরা, ‘খামুশ’!
‘বেলফোর ঘোষণা’ আর মানি না!
শান্তি আলোচনা চিরতরে পুঁতে ফেললাম মাটির গভীরে!
আমরা জানি— তোমরা ৪৮ এর সীমানা মানো নি। তোমার ৬৭ এর সীমানাও মানছো না! এখন তোমরা পূর্ণ জেরুসালেম গিলতে চাইছো! তোমাদের আর সুযোগ দেয়া যায় না! আমরা আরও জানি— আলকুদস দখল করতে পারলে তোমরা থামবে না—নজর দেবে আলআকসায়! হায়কালের খোঁজে! হায়কাল খুঁজতে তোমরা হাত দেবে আলআকসার গায়ে!
না! আলআকসার গায়ে তোমাদের হাত দিতে দেবো না!
আলকুদসে তোমাদের ঢুকতেই দেয়া হবে না!
কান পেতে শুনে নাও—আমাদের লালরেখা অতিক্রম করবে না!
আমাদের ফিলিস্তিন শুধু আমাদের!
আমাদের জেরুসালেম শুধু আমাদের!
আমাদের আলআকসা শুধু আমাদের!
এসবই আমাদের লালরেখা!
এ রেখা অতিক্রম করতে চাইলে বইবে লাল রক্ত! টুকটুকে লাল রক্ত!!
এ রক্ত বইয়ে দিতে আমরা একটুও দ্বিধা করবো না!
পরিবার-পরিজন রেখে,
বাবা-মার বন্ধন ছেড়ে,
প্রিয়তমার চোখে বিরহের অশ্রু বইয়ে দিয়ে,
এতিম হওয়ার ভয়ে চিৎকার জুড়ে-দেয়া ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের মাথায় হাত রেখে আমরা বেরিয়ে যাবো—
আলকুদস রক্ষার চূড়ান্ত জিহাদে!
কেউ আমাদেরকে ফেরাতে পারবে না!
কোনো বন্ধন আমাদের রুখতে পারবে না!
চার.
আর নয় চুক্তি-চুক্তি খেলা
ইহুদিরা কে— আমরা বেশ জানি। চুক্তি করে আর ভাঙে। প্রতিশ্রুতি দেয় আর নষ্ট করে। চুক্তি তো নয়, যেনো চড়–ইভাতি—চুক্তি-চুক্তি খেলা। আশ্চর্য! এই চুক্তি-চুক্তি খেলায় যুগের পর যুগ ধরে আমরা ওদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছি! ছোট্ট একটি খ-িত ফিলিস্তিনের অথর্ব ক্ষমতাবান হওয়ার লোভে!
পরাধীন খ-িত ফিলিস্তিন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি শুনেই পশ্চিম জেরুসালেম দিয়ে দেওয়া এবং দখলদারদের মেনে নেওয়া—এ নয় কি একটুখানি ক্ষমতার লোভে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূখ- বিকিয়ে দেওয়া?!
ক্ষমতাসীন ফাতাহকে অমন নতজানু নীতিগ্রহণের অধিকার কে দিলো?
কেনো তারা ‘অসলো শান্তিচুক্তি’র কবলে পড়ে ফিলিস্তিনের মাটি ও মানুষের সাথে এমন গাদ্দারি করলো?
এই চুক্তির কোনো ফল কি তারা এবং ফিলিস্তিনীরা ভোগ করতে পেরেছে, না পারবে? ...
হামাস আসমানের কোনো নিষ্পাপ ফেরেশতা নয়। তবুও তাদের নিরত সম্মান জানাই! মুহূর্তের জন্যেও তারা ফাতাহর মতো নতজানু নীতি গ্রহণ করে নি! নিজেদের সবকিছু ব্যয় করছে তারা অবৈধ দখলদার ইহুদিদের বিরুদ্ধে।
সামনে হামাসের কথা আরও আসবে একটু পরের দিকে।
* * *
এই যে মার্কিন মধ্যস্থতায় চুক্তি, এখানে কে বেশি লাভবান? শুধুই দখলদার শক্তি! তারা চুক্তি-চুক্তি খেলে আর তা বাস্তবায়নের লোভ দেখায় এবং কালক্ষেপণ করে যেতে থাকে। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। ৬৯ বছর সময়টা কি খুব কম সময়? অনেকগুলো যুগের একটি ‘অকার্যকর সময়-স্তূপ’ নয় কি? এ দীর্ঘ সময়ে কী পেয়েছে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী ক্ষমতালোভী ফাতাহচক্র? কিন্তু কী হারিয়েছে ফিলিস্তিন?! হাজার হাজার শহীদ হয়েছে। অনেক বেশি আহত হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে কোথায় কোথায় অনিশ্চিত তাঁবুজীবন বেছে নিতে হয়েছে। শুধু একা নেতানিয়াহুই তার প্রধানমন্ত্রিত্বের দুই মেয়াদে ২৩ বার বসতিস্থাপনের কালো আইন জারি করেছেন—এই আলকুদসে!
আলকুদস ইহুদিকরণে তিনি মরিয়া!
ফিলিস্তিনী বিতাড়নে তিনি আরও মরিয়া!
৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুত ঘোষণায় বসতিস্থাপনের সফল ফল সামনে এসেছে সেই নেতানিয়াহুর!
কিন্তু আমাদের ঘুম তবুও ভাঙে না!
কবে খুলবে আমাদের চোখ?
আর কতো আওড়ানো হবে—
আমরা স্বাধীন ফিলিস্তিন চাই!
স্বাধীন ফিলিস্তিনের রাজধানী হবে জেরুসালেম!
আমরা তখন নেতা ইয়াসির আরাফাতের সমাধি নিয়ে আসবো এই রাজধানীতে !
কিন্তু এখন? ...
এখন কী হবে?! জেরুসালেম কি এখনো আছে আমাদের হাতের মুঠোয়?!
এখনো কি সময় হয় নি ‘কাতাইবু শুহাদা আলআকসা’ রক্ত অভিযান পরিচালনার?
নাকি নতুন করে আবার শুরু হবে মরীচিকাময় ‘শান্তি’ আলোচনা?!
জবাব দাও হে ‘সুলতাহ -প্রেসিডেন্ট’ মাহমুদ আব্বাস?
পাঁচ.
ইহুদিরা ঘাতক
ওদের বন্ধুরা প্রতারক
ইহুদিরা কোনকালে চুক্তি করে রক্ষা করেছে?
কোনকালে ওরা শান্তির পথে হেঁটেছে?
ওরা বজ্জাত, জাত বজ্জাত।
ওদের হাড্ডি বজ্জাত। রক্ত বজ্জাত।
লোমও বজ্জাত। ওরা আগাগোড়া বজ্জাত।
বজ্জাতি ওদের পেশা।
বজ্জাতি ওদের নেশা।
বজ্জাতির সাথে নচ্ছারিও ওদের নেশা।
বজ্জাতি আর নচ্ছারিতে ওরা কালো করে এসেছে নিজেদের ইতিহাস।
ওরা শুধু চুক্তিঘাতক না, মানবঘাতকও!
শুধু কি মানবঘাতক? নবীঘাতকও!
নবীঘাতকদের কাছে কেমন করে আশা করা যায়— চুক্তির ‘নিরাপত্তা’?
মানবতার প্রতি দয়া ও মায়া? ...
ওরা দয়াঘাতকও! মায়াঘাতকও! ওরা সর্বঘাতক!
ওরা পরঘাতক! আত্মঘাতক!
ওরা ডাকাতের মতো ফিলিস্তিন দখল করে বলে—
আমাদের দেশ! আমাদের ইসরাঈল!
আর ফিলিস্তিনীদেরকে বলে—
যাও, জলদি ভাগো! এ সব আমাদের—তোমরা থাকো গিয়ে তাঁবুতে!
হ্যাঁ, এমনই ডাকাত এরা!
এই ডাকাতদের দেশ হবে এই পবিত্র ফিলিস্তিন?
আর মহাপুণ্যভূমি আলকুদস হবে ডাকাতদের ঘোষিত ‘ইসরাঈল’-এর রাজধানী?!
যে পরাশক্তিই এই ঘোষণা দিক, আমরা মানি না—ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি!
এমন ডাকাতদের সাথে চুক্তি অনুষ্ঠানে একত্র হওয়া এবং শান্তি আলোচনা করা—
কী করে সহনীয় হতে পারে?! যেখানে উচিত ‘ডাকাত খেদাও’ আন্দোলন গড়ে তোলার, সেখানে কেনো এলো উটকো ‘ওসলো’?!
ইয়াসির আরাফাত, জানি না, কবরে বসে এ জন্যে আপনি কী পরিমাণ আক্ষেপ করছেন! আপনার উত্তরসূরি মাহমুদ আব্বাস যদি একটু বুঝতেন!
ডাকাতের অবস্থান কে মেনে নেয়?
ডাকাতের সাথে কে চুক্তি করে?
নিজের স্বাধীনতার সওদা করে?
কে তাদের বড়ত্ব ও প্রভুত্ব মেনে নেয়?
কে নিজের ভিটে ছেড়ে দিয়ে কাঁচুমাচু ভঙি নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে?
এই ডাকাতেরা আপনাকে মেরেছে, মাহমুদ আব্বাসকেও ছাড়বে না!
বন্ধুবেশে শত শত ‘দাহলান’ কে লেলিয়ে দেবে!
* * *
এই ডাকাতদের যারা পক্ষ নিয়েছে তাদের সম্পর্কে কী আর বলা যায়! নিশ্চিত তারা ডাকাতদের স্বার্থেই কাজ করে যাবে!
বলি, বৃটেন-আমেরিকা কী দিয়েছে ফিলিস্তিনীদের—
অনিশ্চিত ফেরার শঙ্কাঘেরা তাঁবুজীবন ছাড়া?!
ইহুদিদের ভরণ-পোষণ ও লালন-প্রতিপালনই তাদের একমাত্র ‘ব্রত’!
তারা জাতিসঙ্ঘের কাঁধে ভর করে উপরে উপরে ফিলিস্তিনীদের সান্ত¡না দেয়—মায়াকান্না কাঁদে আর ভেতরে ভেতরে ফিলিস্তিনী হত্যার সবুজ সংকেত দেয়— যতো পারো মারো ফিলিস্তিনীদের! আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি!
আসলেই তারা দখলদারদের সাথে আছে।
সাথে থাকতে থাকতে সব পাইয়ে দিচ্ছে।
জেরুসালেম পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ও ঘোষণা দিলে আর কী বাকি থাকে?
ইহুদিদের বন্ধুদের সাথে আরও কি চলবে— ‘ উষ্ণ করমর্দন’?
অযাচিত কৃত্রিম হাসি মুখে নিয়ে নিষ্প্রাণ ‘ফটোসেশন’?
আহা, দুশমনের সামনে এই হাসি-যে কী বোকামির!
এই হাসি হাসতে দেখে দুশমনও হাসে!
ওদের হাসির ভাষা যেনো বলে—
বোকার দল! যেমনে নাচাই তেমনি নাচে!
তোরা সব হারাবি হে বোকার হাসি-হাসা বোকার দল!
ছয়.
চুক্তি নষ্ট করা ইহুদিদের পুরোনো অভ্যাস
ইহুদিদের চুক্তি ভাঙার ইতিহাস অনেক পুরোনো। এরা আজন্ম চুক্তিভাঙা অভিশপ্ত এক জাতি। এরা আল্লাহর সাথে চুক্তি ভেঙেছে। এরা আল্লাহর রাসূলের সাথে চুক্তি ভেঙেছে। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত পর্যন্ত করেছে। একবার উপর থেকে পাথর ছোড়ে, বনুনজিরের ইহুদিদের পক্ষ থেকে। আরেকবার বিষ প্রয়োগ করে , খায়বার বিজয়ের পরে। আরও একবার এই ইহুদিরা ছোট্ট মুহাম্মদকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো, যখন তিনি হালিমা সা‘দিয়্যার কাছে ছিলেন।
নিজেদের নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে এরা অতিষ্ঠ করে তুলেছিলো—
কখনো গো-বৎস পূজায় লিপ্ত হয়ে।
কখনো যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে।
কখনো মান্ন-সালওয়ার মতো মহাসুস্বাদু আসমানী খাবার খেতে অস্বীকার করে।
কখনো প্রকাশ্যে আল্লাহকে দেখার অদ্ভুত ‘বায়না’ ধরে।
কী ধৃষ্টতায় এরা বলতে পেরেছিলো নিজেদের নবীকে—
‘যাও, তুমি আর তোমার রব গিয়ে লড়াই করো গে! আমরা এইখানেই বসে থাকবো!’ [সূরা মায়েদা]
এমন বজ্জাতদের সাথে কিসের আবার শান্তিচুক্তি?
কোন্ শান্তির দিকে এরা ডাকে?
সেই শান্তি, যা ফিলিস্তিনীদের ঘরবাড়ি ভেঙে চুরমার করে দেয়?
তাদের ভিটেছাড়া করে?
তাদের উপর ‘দশ বছরের’ অবরোধ চাপিয়ে দেয়?
হাজার হাজার মানুষকে বন্দী করে রাখে?
কেমন শান্তির দিকে ডাকে এরা?
এমন শান্তি কি, একপক্ষের চলার স্বাধীনতা থাকবে আরেক পক্ষের হাত-পা বাঁধা থাকবে?
এক পক্ষ আত্মরক্ষা করবে আধুনিক মারণাস্ত্র বহন করে, আরেক পক্ষের জন্যে আগ্নেয়াস্ত্র স্পর্শ করাও হয়ে যাবে অবৈধ?!
কী অদ্ভুত বিচার-আচার!!
নিজেরা জুলুম করলে হয়ে যায় আত্মরক্ষার অধিকার!
ফিলিস্তিনীরা ইট-পাথর-গোলাইল দিয়ে প্রতিরোধ করলে হয়ে যায় সন্ত্রাস!
أَيْنَ السَّلاَمُ الَّذِي نَادَتْ مَحَافِلُكُمْ؟ + أَيْنَ الشَّعَارَاتُ يَا مَنْ بَاتَ يُطْرِيهَا؟
تَآمُرٌ لَيْسَ تَخْفَانَا غَوَائِلُهُ + وَفِتْنَةٌ نَتَوَارَى مِنْ أَفَاعِيهَا
কোথায় তোমাদের আসর-উচ্চারিত ‘ওম’ শান্তি? / কোথায় তোমাদের অতিপ্রশংসিত শান্তি-চিহ্ন?
সবই ফিসফিস চক্রান্ত, এর ধ্বংসতা-ব আমাদের অজানা নয়! / এর আড়ালে লুকিয়ে আছে বিষাক্ত ভয়ঙ্কর সাঁপের ‘ছোবল’!
এমন শান্তির আশায় বসে আছেন মাহমুদ আব্বাস?
এমন ইহুদিদের কাছে?
এরা তাকে বানাবে স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট?
এরা দেবে স্বাধীন বিমানবন্দর? সমুদ্রবন্দর? আলাদা মুদ্রা?
কেনো তাহলে ফাতাহ ছেড়ে বসে আছে জিহাদের পথ?
৬৯ বছর ধরে কালক্ষেপণ করে যাচ্ছে?
কেনো সঙ্গ দিচ্ছে দুশমনের চুক্তি-চুক্তি খেলায়?
অংশ নিচ্ছে শান্তি-শান্তি মেলায়?
মদীনার ইতিহাস কি আমরা ভুলে গেছি?
বারবার ইহুদিরা চুক্তি ভেঙেছে। বনুকায়নুকা, বনুনজির ও বনুকোরায়যার চুক্তি ভাঙার ইতিহাস এবং এর পরিণতি কি আমাদের সামনে নেই?
খায়বারে বসেও ইহুদিরা চক্রান্তে মেতে উঠেছিলো। শেষে খায়বার অভিযানে ওদের শোচনীয় পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। দুর্ভেদ্য দুর্গের নিরাপদ ‘বসবাস’-এর উপর নেমে এসেছিলো ‘আলী হায়দারী মহাঝড়’। ওদের মেরুদ- ভেঙে পড়েছিলো। স্বপ্ন-সাধ আর চক্রান্তের সব জাল ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো।
বর্তমান ইহুদিরা ওই ইহুদিদেরই অবিকল ছায়া। এরাও ওরাই।
এরাও চুক্তি ভাঙার উৎসব করে।
কূটচক্রান্তের অন্ধ গলিপথ পেরিয়ে পেরিয়ে ফিলিস্তিনসহ আরববিশ^ দখলের নকশা আঁকে। নীল-ফুরাতের স্বপ্ন দেখে।
এরা যেখানে থাকে সেখানেই ত্রাস ছড়ায়।
এরা আবার খায়বারে ফিরে যেতে চায়।
ওই ভেঙে পড়ে থাকা কেল্লা মেরামত করতে চায়।
ওখানে (খায়বারে) ইহুদি ও তাদের বন্ধুরা কিচ্ছুটি (কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন) করতে দিতে চায় না সৌদি সরকারকে।
এদের চাওয়ার কোনো শেষ নেই।
এরা চাইতে চাইতে সব বিকিয়ে দিতে পারে, তবু এদের চাওয়ার পিপাসা মেটে না।
পাওয়ার ক্ষুধা মেটে না।
চাওয়া-পাওয়ার পিপাসা ও ক্ষুধা মেটাতে এরা নিজেদের ‘হারিম’কেও (নারীদেরকেও) বলি দেয়।
চরিত্র বিলিয়ে দেয় হাসতে হাসতে।
এরা ফাঁদ পাতে আর শিকার ধরে।
শিকার ধরে আর উৎসব করে।
বলি দিয়ে বলি করে।
ফাঁদ পেতে কুপোকাত করে।
এরা চিরকালের অশান্তি সৃষ্টিকারী।
এরা বিষ। এদের চিন্তায় বিষ। দেহে বিষ। মনে বিষ।
এই বিষে বিষে এরা সবাইকে বিষিয়ে দিতে চায়।
এদের বিষ-বিষ জীবাণু ঢেলে ফিলিস্তিনকে বিষাক্ত করে তুলতেই ১৪ মে ১৯৪৮ সালে দখল-অভিযান শুরু করে। ইসরাঈল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ১৯১৮ সালে ব্রিটেনের সহযোগিতায় গুপ্ত ইহুদি বাহিনী ‘হাগানাহ’ গঠিত হয়। এই বাহিনী ইহুদিদের রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদিদের সহায়তা করা এই ‘হাগানাহ’ বাহিনীর মূল কাজ হলেও এরা পরে আস্ত এক সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের ঘরবাড়ি, খেত-খামার সব দখল করে বসে। ফিলিস্তিনীদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করতে থাকে। বাজার ও রাস্তাঘাট থেকেও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ফিলিস্তিনীদের বিতাড়ন ত্বরান্বিত করে তোলে। জাতিসঙ্ঘ যেনো গায়ে পড়েই এদের পক্ষ নেয়। ১৮১ নম্বর প্রস্তাব পাশ করে। এ প্রস্তাব পাশ করে জাতিসঙ্ঘ যেনো ঘোষণা দিলো ফিলিস্তিনীদের লক্ষ করে—
‘প্রিয় ফিলিস্তিনী বন্ধুরা’, এদেরকে ৫৫ ভাগ জায়গা ছেড়ে দাও! এরা জোর করে এখানে এলেও এরা ‘ভালো’ মানুষ! এদের জন্যে অশান্তির কারণ হয়ো না! তোমরাও থাকবে ৪৫ ভাগ জায়গা নিয়ে!
হায় জাতিসঙ্ঘ, আরেক দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব কেমনে তুমি তুলে দিলে একটি ডাকাতশ্রেণির হাতে?! তারপরও তুমি সবার? আন্তর্জাতিক সংস্থা?
এরপর কী তা-ব নেমে এলো সবুজ-শ্যামল ত্বীন-যায়তুনময় ফিলিস্তিনের উপর, সে কথা আমরা একটু বলে এসেছি!
সাত.
আসবে কি সুখের ওই রোদেলা দুপুর
৪৮ সালের কালো ঘোষণা এবং ঘৃণিত ইহুদি তা-বের কথা কখনো ভোলা যাবে না। ফিলিস্তিনের গায়ে সেদিন যে-আঘাত শুরু হয়েছিলো এবং যে-ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিলো, তা থেকে এখনো রক্তক্ষরণ ঘটে চলেছে, অবিরাম। সীমাহীন। বারবার ফিলিস্তিন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ছে। জাতিসঙ্ঘ তার কালো প্রস্তাব ও ঘোষণায় বৈধতা দিয়েছিলো— একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্রে একটি অভিশপ্ত ডাকাতদলকে নির্বিচারে ডাকাতি করার।
না, জাতিসঙ্ঘ-নির্ধারিত সীমানায় এই ডাকাতদল সীমাবদ্ধ থাকতে পারে নি। এমনকি ৬৭ সালে দখলকৃত সীমানা নিয়েও সন্তুষ্ট থাকতে পারে নি। বিরামহীনভাবে ডাকাতি চালিয়ে একের পর এক ভূখ- দখল করে আবাসন গড়ে তুলেছে। মাত্র দশ বছরে এরা ৪৫টি আবাসন গড়ে তুলেছে।
ইহুদিদের ডাকাতি এখনো বন্ধ হয় নি। এরা যতো শক্তিশালী ও সংহত হচ্ছে এদের ডাকাতি ততোই দুর্ধর্ষ হয়ে উঠছে। দিনের আলোয়, রাতের আঁধারে—যখন তখন ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘরে হানা দিচ্ছে। একটুখানি প্রতিবাদ চোখে পড়লেই গুলি ছুড়ছে। রক্ত বইয়ে দিচ্ছে, শিশুর। কিশোরের। নারীর। বৃদ্ধের। সবার।
এই ইহুদিদের অপরাধের কোনো সীমা নেই। যুগের পর যুগ ধরে এরা অপরাধ সংঘটিত করে যাচ্ছে। এদের অপরাধ-তা-ব থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। জনপদের পর জনপদ উজাড় করে দিচ্ছে। বাস্তুভিটে ছেড়ে কতো হাত-পা ভাঙা পরিবার পালিয়ে গেছে। প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে ‘রাজকীয়’ স্বাধীন জীবনের পর শূন্য ও অভাবঠাসা এবং কষ্ট ও দুঃখঘেরা তাঁবুজীবন। কেউ জর্দানে। কেউ লেবাননে। কেউ সিরিয়ায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় দরোজাটা ‘ভেজিয়ে’ (বন্ধ করে) ভেজা চোখে তালা লাগিয়ে চাবিটি কেউ কেউ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো। ওই চাবি এখনো আছে! কতো আগের, মরচে ধরে গেছে! মরচে বসে গেছে! এখনো এই চাবি আছে কঠিন তাঁবুজীবনের ভেতরে ‘সূর্যের আলো’ হয়ে। যুগ যুগ চলে গেলেও এখনো তারা স্বপ্ন দেখে— একদিন তারা সবাই ঘরে ফিরে যাবে! স্বাধীন ফিলিস্তিনের কাঁপা-কাঁপা পতাকা উড়িয়ে! এই মরচে-পড়া চাবি দিয়ে খুলতে পারবে কি ওই অদেখা মরচে-পড়া তালাটি? আসবে কি সেই সুদিন? সুখের রোদেলা দুপুর?!
আট.
আজব রাষ্ট্র .. আজব প্রস্তাব
ফিলিস্তিন নিয়ে এখন কী হচ্ছে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে হয় আর ‘নাটক’ করতে প্রস্তুত না! তারা এখন বড্ড ক্লান্ত। এখন ফিলিস্তিন নিয়ে ‘ফাইনাল ম্যাচ’ খেলতে চায় তারা। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়ে দেখিয়ে পার করে দিয়েছে প্রায় ৭০ বছর। আর কতো? এখন আসল চেহারায় সামনে আসতে চাইছে ‘বাজিকরেরা’।
না, জেরুসালেম ফিলিস্তিনীদের দেওয়া হবে না!
বর্তমানে যে অবস্থা এই ফিলিস্তিনীদের, এরচেয়ে বেশি ক্ষমতা তারা আর দিতে চায় না। বরং আরও অনেক কমিয়ে দিতে চায়। বরং ফিলিস্তিনীরা যে আলআকসা আর আলকুদস নিয়ে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে, তারও গলা চেপে ধরতে চায় তারা। আরও ছোট্ট একটা স্বায়ত্তশাসনের মতো অঞ্চল দিয়ে ছোট্ট একটা রাজধানী দিয়ে তারা ফিলিস্তিনকে চুপচাপ বসিয়ে রাখতে চায়। আর না মানলে কিছুই আসে যায় না! মহাইসরাঈল প্রতিষ্ঠার মহালক্ষ্য নিয়েই তারা এগিয়ে যেতে চায়। মিসর তাদের পাশে থাকবে। আমিরাত পাশে থাকবে। ইবনে সালমান অবশ্যই পাশে থাকবে। জর্দানকেও পাশে থাকতে হবে। এভাবে ফিলিস্তিনীদের ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’কে তারা এখন কবর দিতে চায়। তাদের ভাবখানা এমন—ওদের এতোই রাজধানীর শখ হলে ‘আবুদিস’ গ্রামটাকে রাজধানী বানিয়ে দিলেই হবে! ইবনে সালমানের মাধ্যমে সে প্রস্তাব ফিলিস্তিনীদের কানে ঢেলে দিতে হবে, লোভ লোভ ভাষায়, হাসি হাসি মুখে! তাহলেই ওরা গলে যাবে! ...
হ্যাঁ, এমন পরিকল্পনা নিয়েই আগে বাড়ছে ইহুদি ও তাদের সুহৃদ আমেরিকা। পরিকল্পনামতোই প্রস্তাবটা সরাসরি নিজেরা পেশ না করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জ্যারেড কুশনারের ‘বিশেষ বন্ধু’ ইবনে সালমানকে। বাদশা সালমান কিংবা ইবনে সালমান তুর্কি প্রেসিডেন্ট আহূত ওআইসি সম্মেলনেও যোগ দেন নি। সাধারণ পরিষদে ‘একেবারে শেষবেলা’ ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়েছে সৌদি আরব। যেনো একরকমের মান রক্ষা। কিন্তু তাদের নিয়তে মনে হয় গোলমাল আছে। নইলে এ ভোটের পরে কেনো উল্টো সুরে ‘গান গাওয়া’? জনাব মাহমুদ আব্বাসকে ডেকে এনে ‘আবুদিস’কে রাজধানী মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন ইবনে সালমান, ওআইসি সম্মেলনের পর!
মজার ব্যাপার হলো, আবুদিসকে রাজধানী মেনে যে ‘সাম্রাজ্যের’ মালিক হবেন মাহমুদ আব্বাস, তা শুধু পশ্চিম তীর আর আলাদাভাবে গাজার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আবার পশ্চিমতীরে অবস্থিত কোনো ইহুদি বসতিও প্রত্যাহার করা হবে না। এর মানে ইহুদিরা সেখানে সংখ্যগুরু হিসাবে অবস্থান করবে। আজব রাষ্ট্র! আজব প্রস্তাব!
নয়.
আপনার ভিশন কিন্তু ভীষণ ...
মনে পড়ে মরহুম বাদশা ফয়সালের একটি ভাষণের কথা। সেখানে তিনি ফিলিস্তিনের ষোলো আনা পক্ষে কথা বলেছিলেন। আর তাঁর ভাই-ভাতিজারা অবস্থান নিয়েছে সরাসরি ইহুদি ও আমেরিকার পক্ষে। বিশেষ করে ‘এমবিএস’ ও ‘মিস্টার এভরি থিং’ খ্যাত এই যুবরাজের বিতর্কিত কর্মযজ্ঞ মুসলিম উম্মাহর ভেতরে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আলকুদস থেকে সরে আসার কল্পনাও করতে পারে না যেখানে মুসলিম উম্মাহর কোনো সদস্য, সে জায়গায় বলতে গেলে নিজের হাতে ইহুদিদের হাতে আলকুদসকে তুলে দিতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নিঃসন্দেহে বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক এবং দুশ্চিন্তার বিষয়। কেনো ইহুদিঁেঘষা এই মনোভাব তার? ইচ্ছায় না অনিচ্ছায়? ইচ্ছায় হলে এ রাজপুত্তুরের জন্যে শত আফসোস, উম্মাহর এবং ফিলিস্তিনের বিপক্ষে এই ন্যক্কারজনক অবস্থানগ্রহণের জন্যে! সময় ও আদর্শ বদলের কী নির্মম দৃশ্যায়ন! চাচা আর ভাতিজার ব্যবধান কতো বেশি!!
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই রাজার ছেলে নিজের সামনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ‘জীবিত’ রাখতে চাইছেন না। রোষমত্ত সিদ্ধান্তের তা-বে তার ‘আদালতে’ এর মাঝেই দ-প্রাপ্ত হয়েছেন—একের পর এক দাঈ, আলেম, রাজপ্রাসাদের বিলাসী জীবনে বেড়ে ওঠা দূরের ও কাছের যুবরাজেরা। বিলিয়ন ও ট্রিলিয়নপতি ব্যবসায়ীরাও।
পর্যবেক্ষক তথ্যাভিজ্ঞ মহল লক্ষ করছেন— প্রাসাদঘেঁষা আলেমরাও এই রাজার ছেলেকে সমর্থন যুগিয়ে কথা বলছেন। ইসরাঈলের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম—এমন কথা নাকি বলা হয়েছে!
আমাদের বিনীত জিজ্ঞাসা— হে হারামাইনের প্রতিবেশধন্য বিজ্ঞজনেরা, সত্যি কি আপনারা ট্রাম্প-ঘোষণার সাথে একমত? জেরুসালেম ইসরাঈলের রাজধানী মানেন? ... তাহলে কান পেতে শুনে রাখুন, মুসলিম উম্মাহর ওয়াফাদার সদস্যরা আপনাদের সাথে একমত না! তারা মনে করেন— দুশমন এই যুবরাজের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে উম্মাহর স্বার্থ ও ভাগ্য নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। উম্মাহর এই সদস্যরা আরও মনে করেন— আলকুদস ও ফিলিস্তিনের ব্যাপারে সৌদি আরবের বর্তমান অবস্থান বাদশা ফয়সালের নীতি-আদর্শের সাথে সুস্পষ্ট বিশ^াসঘাতকতা।
* * *
যুবরাজের চলমান ঝড়ো সিদ্ধান্ত নিয়ে এখানে কথা বলবো না। অবকাশও নেই। ‘শ্যাত লুই ফোরটিন’ নিয়েও এখানে কথা বলবো না। ‘নিওম প্রজেক্ট’ নিয়েও কথা বলবো না, শুধু জানতে চাইবো—
আপনার নিওন পর্যটন নগরীতে নারীরা বিকিনি পরে ঘুরতে পারবে?!
সিনেমা, থিয়েটার, পাশ্চাত্যধারার বিনোদন—সবকিছুই অবাধে চলবে?!
জনাব, তাহলে কি খুলে দেয়া হচ্ছে ইউরোপীয় সংস্কৃতির দরোজা?!
মিস্টার যুবরাজ! কী করতে আসলে চান আপনি?
শুনেছি, এই নিওন সিটির বাইরেও আয়োজন চলছে আপনার ‘ভিশন মতে’ শত শত সিনেমা হল স্থাপনের!
আপনি কি ইসলামকে ‘আপনার দেশে’ মাজলুম বানাতে চান?
শুধু মক্কা-মদীনায় বন্দী করে ফেলতে চান?
ইতিহাস কি আপনাকে ক্ষমা করবে? ...
কিন্তু হে আগামী দিনের বাদশা, উদার ইসলামের বিষাক্ত পরিভাষা ব্যবহার করে কেনো এসব অসুন্দরের আয়োজন?
প্রিয় নবীর পরশধন্য পুণ্যভূমি কি এসব ‘হজম’ করবে বলে ভেবেছেন?
কেনো আপনি হঠাৎ ঝড়ো বেগে উদিত হয়ে উল্টোপথে মহাসমারোহে যাত্রা শুরু করলেন?! কাঁচা-কাঁচা ডলারের লোভে?
তেল ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়?
আপনার ভিশন কিন্তু ভীষণ ...!
সাবধান! জাযিরাতুল আরবকে আপনারা সৌদি আরব বানিয়েছেন, মেনে নিলাম! কিন্তু নবীর দেশকে ইউরোপ-আমেরিকা বানাবেন, মানবো না!
দুঃখিত, মিস্টার যুবরাজ, আমরা সীমাহীন দুঃখিত!!
দশ.
পৃথিবী কি আমেরিকার গোলাম
সৌদি যুবরাজকে নিয়ে এসব কথা অবতারণার কোনোই প্রয়োজন হতো না, যদি না তিনি—জ্যারেড কুশনারের কবলে পড়তেন!
ট্রাম্প-ঘোষণার সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করতেন!
মাহমুদ আব্বাসকে ডেকে এনে শাসাতেন। অনুরোধ করতেন!
‘আলদিস’কে খ-িত ছোট্ট ফিলিস্তিনের রাজধানী প্রস্তাব করতেন!
যদি না তিনি—
শত্রুর প্ররোচনায় উম্মাহর স্বার্থবিরোধী এই যুদ্ধে নামতেন।
* * *
সৌদি ও যুবরাজ বলে কথা না, যারাই জেরুসালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিনের রাজধানী মানবে না, তাদের বিরুদ্ধেই মুসলিম উম্মাহর অবস্থান! উম্মাহর প্রহরীরা শেষ হয়ে যান নি। তীব্র প্রয়োজনের সময় তারা যুগে যুগে জন্ম নিয়েছেন—বেরিয়ে এসেছেন। কিছু কিছু মুসলিম দেশ যখন ট্রাম্পতটস্থ, তখন জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে এই ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদেও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আমেরিকা ‘প্রাণে বেঁচেছে’ ভেটো-ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কিন্তু সাধারণ পরিষদে এসে মারাত্মক হোঁচট খেলো আমেরিকা। ১২৮-৯ ব্যবধানে আমেরিকা সোজা ধরাশায়ী হয়েছে। অবশ্য এখানে কিছু ভোট ছিলো ‘নেফাকমিশ্রিত’! সে প্রসঙ্গ থাক।
এই ফলাফলে লজ্জা থাকলে আমেরিকার লজ্জা পাওয়া উচিত ছিলো। উল্টো আমেরিকা নাকি ‘দেখে নেয়া’র হুমকি দিয়েছে!
সারা পৃথিবী কি আমেরিকার গোলাম?
তার পক্ষে না থাকলে চোখরাঙানি দেখতে হবে?
এগারো.
ইসরাঈল একটি অবৈধ দখলদার ডাকাত দেশ
এই ঘোষণায় হামাস-এর ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে?
এই ঘোষণায় হামাসের প্রতিক্রিয়া সীমাহীন (ষোলো আনা) নেতিবাচক! হামাস ঘোষণা দিয়েছে—
এ সিদ্ধান্ত তারা কিছুতেই মেনে নেবে না।
হাজার হাজার শহীদের রক্তের সাথে তারা বেঈমানী করবেন না।
তারা আরও বলেছেন—
ইসরাঈল নামে কোনো রাষ্ট্রকে তারা বৈধ মনে করেন না।
ইসরাঈল অবৈধ। দখলদার। ডাকাত।
ফিলিস্তিন শুধু ফিলিস্তিনীদের।
আলআকসা শুধু মুসলমানদের।
আলকুদস শুধু মুসলমানদের।
আলকুদসে কোনো বিভাজন নেই।
পূর্ব-পশ্চিম নেই।
আলকুদস হিয়া কুল্লুল কুদস! লা শারকিয়্যাহ ওয়ালা গারবিয়্যাহ!
আমেরিকার ফিলিস্তিনবিদ্বেষ এখন সামনে এসে পড়েছে। আমেরিকা শান্তি আলোচনার আয়োজক হতে পারে না। আমেরিকা ইসরাঈলের। ইসরাঈল আমেরিকার।
হামাসের কণ্ঠে কণ্ঠে এখন ধ্বনিত হচ্ছে আকাশ-বাতাস ছাপিয়ে—
لو خضعت كل الدنيا لن نعترف باسرائيل
সারা দুনিয়া বিরুদ্ধে চলে গেলেও আমরা ইসরাঈলকে মেনে নেবো না!
* * *
হামাস ১৯৮৭ সালে ১৪ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় শায়খ আহমদ ইয়াসিনের হাত ধরে। প্রথম ইন্তিফাদার অগ্নিঝরা চরমোত্তাল সূচনাকালে। হামাস ফিলিস্তিনের স্বপ্ন। ইসরাঈলের মহাআতঙ্ক। দ্রুম দ্রুম দ্রোহ। চিরআপসহীন। হামাস সেই সূচনা থেকে এখনো পর্যন্ত এক আদর্শের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। তা হলো—
ফিলিস্তিনের মানচিত্রে ইসরাঈল নেই, আছে একটি ডাকাত রাষ্ট। অবৈধ রাষ্ট্র। এই ডাকাত ও দখলদারদের বিরুদ্ধেই হামাসের লড়াই ও সংগ্রাম। রক্তঝরা মুক্তিযুদ্ধ। হামাস বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। ফিলিস্তিনের খাঁ-খাঁ সমরশূন্যতার ভেতরে দখলদারদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া একটি সামরিক শক্তি। দিনে-রাতে সব সময় ইহুদিদের বিরুদ্ধে হামাস এর যুদ্ধ চলমান। যখন আমি এই লেখা লিখছি তখনো হামাসের কেন্দ্রবিন্দু গাজায় ইহুদিরা বিমান ও ট্যাংক হামলা চালাচ্ছিলো।
কিন্তু হামাস ক্লান্ত হয় না। হামাস শ্রান্ত হয় না। হামাস চিরঅক্লান্ত। রণে-রণে সৈন্যরা ক্লান্ত হয় আর হামাস জেগে জেগে ওঠে অক্লান্তির চিরশক্তিতে। শহীদের মিছিলে যোগ দিয়েছে হামাসের কতো শীর্ষ সারির নেতা। খোদ প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদ ইয়াসিন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত আবদুল আজিজ রানতিসী। শায়খ আহমদ আলজা‘বারী। ইয়াহইয়া আইয়্যাশ। আরও কতো নেতা-যুবক-কিশোর-শিশু— ফিলিস্তিনের জন্যে বিলিয়ে দিয়েছেন সবাই বুকের তাজা-তাজা রক্ত। ফিলিস্তিনের মায়ের কোলে নতুন নতুন শিশু আসে আর মায়ের মুখে হাসি ফোটে। কেননা, এই শিশুরা আগামী দিনের শহীদ হবে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্যে রক্ত দেবে।
ইহুদিদের সাথে হামাস সার্বক্ষণিক লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি একাধিক সর্বাত্মক যুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়ে গৌরবের বিজয় তুলে এনেছে। রক্ত দিয়ে, রক্ত নিয়ে। হামাস-বীরেরা ‘বীরোচিত বীরত্ব’ প্রদর্শন করে মুখে জান্নাতি হাসির টুকরো নিয়ে লুটিয়ে পড়ে শাহাদতের লাল-সবুজ গালিচায়। দখলদারদের অস্ত্র, গুলি, বিমান-আক্রমণ— কিছুই তাদেরকে ভয় দেখাতে পারে না। প্রথম ইন্তিফাদায় পাথর আর গোলাইল নিয়েই জ্বলে উঠেছিলো হামাস। এ জন্যে এই ইন্তিফাদার নাম ছিলো—‘পাথর ইন্তিফাদা’। ‘মসজিদ ইন্তিফাদা’ও বলেন অনেকে। কেননা, মসজিদ থেকে ঘোষণা প্রচার হতে থাকতো—কখন কোথায় যেতে হবে এবং আক্রমণ ও প্রতিরোধ-যুদ্ধে কীভাবে অংশ নিতে হবে।
আলাদা করে প্রথম ইন্তিফাদার কথা একটু খুলেই বলি—
দিনে দিনে এ ইন্তিফাদায় জোয়ার সৃষ্টি হতে লাগলো। জাবালিয়া থেকে সারা ফিলিস্তিনে এবং উদ্বাস্তু শিবিরেও এর জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ পৌঁছে গিয়েছিলো। ইসরাঈল আশি হাজার সৈন্য নামালো পরিস্থিতি সামাল দিতে। পারলো না। ইসহাক রবিন (তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী) নির্দেশ দিয়েছিলো—ফিলিস্তিনীদের ধরে ধরে হাড্ডি ভেঙে দিতে। কিন্তু তার জানা ছিলো না, হাড্ডি ভেঙে ভেঙে শেষ করা যাবে না ফিলিস্তিনের এই হাড্ডি!! কতো হাড্ডি ফিলিস্তিনীদের, কয়টি ভাঙবে ইসহাক রবিন?! তারা পিছু হটলো। ইন্তিফাদার ভয়ে ও উষ্ণতায় ইহুদিরা কাঁপতে লাগলো, পুড়তে লাগলো। অবশেষে অসলো ‘শান্তি’চুক্তি করে সাময়িক রেহাই পেলো।
হামাস শুরুতে পরিচিত না হলেও এই ইন্তিফাদার পরে ইসরাঈলের জন্যে জ্বলন্ত আতঙ্ক হয়ে উঠলো। প্রথম ইন্তিফাদায় হামাস শুধু পাথর আর গোলাইল ব্যবহার করলেও পরবর্তী সময়ে তাদের সমরশক্তিতে বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। ধীরে ধীরে যোগ হয়েছে বন্দুক। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। স্বল্প মাঝারি ও দূরপাল্লার স্বনির্মিত ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১৪ সালের শেষ যুদ্ধে চালকবিহীন বিমানও প্রদর্শিত হয়েছে—আকাশে উড়েছে। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের যুদ্ধের পর এখন তৃতীয় যুদ্ধের জন্যে হামাস আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি প্রস্তুত। হামাস এখন হিযবুল্লাহর চেয়েও শক্ত প্রতিপক্ষ। তাই হামাসের নাম শুনলে ইহুদিদের বুক কাঁপে, শীত ছাড়াও হাঁড় কাঁপে। হামাস যেনো ইহুদিদের অন্তর্কাঁপুনি। সাক্ষাৎ ‘আযরাঈল’।
১৯৯৩ সালের দিকে এই ইন্তিফাদা শান্ত হয় ওই অসলো চুক্তির ভেতর দিয়ে। ১১৬২ ফিলিস্তিনী শহীদ হয়। ২৪১ জনই শিশু। আহত হয় ৯০ হাজার ফিলিস্তিনী। ১২২৮টি ঘর গুঁড়িয়ে দেয় দখলদার বাহিনী। দুষ্ট ইহুদিরা ১৪০টি বৃক্ষও উপড়ে ফেলে।
এ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো আমেরিকার ‘সাদাঘরে’ ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাঈলের মাঝে।
একটুখানি ক্ষমতা ‘বগলতলায়’ করে নিয়ে ফিরে আসেন জনাব ইয়াসির আরাফাত। পশ্চিম তীর আর গাজার শাসনক্ষমতা। আহ! কেনো যে এমন হলো! কেনো ইয়াসির আরাফাত আরও গলা উঁচু করে স্বাধীন ফিলিস্তিন দাবি করতে পারলেন না? একটুখানি ক্ষমতা তাকে কেনো ভুলিয়ে দিলো—পেছনের ইন্তিফাদার লাল রক্তের কথা?
ক্ষমতার কী শক্তি, রক্তের সাথেও গাদ্দারি!
অথচ ইয়াসির আরাফাতও পরে বেশিদিন বাঁচতে পারেন নি। ইহুদিরা তাকে আর সইতে পারছিলো না। বিষপ্রয়োগে হত্যা করে!
বর্তমানের ফাতাহ কি সেই নীলবেদনার ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাই নেবে না?!
* * *
হামাসের সামরিক শাখার নাম—কাতাইবু ইয্যিদ্দীন আলকাস্সাম। বিস্ময়কর অস্ত্র ও রণকৌশল নিয়ে এগিয়ে চলেছে এই বাহিনী—বাধার পাহাড় এবং শত্রুদের হিংসাত্মক সমালোচনা ডিঙিয়ে। হামাসের লক্ষ্য একটিই— দখলদারমুক্ত অখ-িত স্বাধীন ফিলিস্তিন। এ লক্ষ্য অর্জনের পথে হামাস কোনো আপস করতে চায় না। ফিলিস্তিনের এক ইঞ্চি মাটিও বিক্রি করতে চায় না। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথেও তারা হাঁটতে চায় না। পূর্ব জেরুসালেম স্বাধীন ফিলিস্তিনের রাজধানী— একথাও তারা মানে না। আগেই বলেছি—
সবার প্রিয় হামাস—এতিম, শিশু-কিশোর এবং অবলা বিধবা নারীদের চোখে এখন স্বপ্ন বিতরণ করে চলেছে। একদিন ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে।
জেরুসালেম তার রাজধানী হবে।
আলআকসায় নামায পড়তে আর কোনো বাধা থাকবে না।
কষ্টঘেরা তাঁবুজীবন ছেড়ে ফিরে আসবে—‘চোখে অশ্রু-মুখে হাসি’ ফিলিস্তিনীরা।
দখলদারদের ধ্বংস-তা-বের শিকার না হয়ে থাকলে সেই পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবেন এই ঘরটির সাথে পরিচিত-অপরিচিত অনেক মানুষ!
তারপর কী হবে?
তারপর দাদি বেঁচে থাকলে দাদিই, নইলে নাতনি খুলবেন পুরোনো চাবিটি দিয়ে পুরোনো তালাটি। তারপর ঘরে প্রবেশ করবেন সবাই। স্যাঁতসেঁতে ঘরটিই তখন আলো ছড়াবে তাদের চোখের সামনে। স্বাধীনতা ও তৃপ্তির আলো। কবে আসবে অশ্রুভেজা হাসিমাখা সেই আলো-ঝলমলে সুদিন?
বারো.
ফাতাহ সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। সব স্পষ্ট। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। শুধু বলবো—হায়, ফাতাহ যদি হামাস-এর মতো হতো!
* * *
মিস্টার ট্রাম্প তার ঘোষণা থেকে ফিরে আসবেন কি আসবেন না— এটা ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তিনপ্রেমীদের কাছে এখন বড় প্রশ্ন না। বড় প্রশ্ন হলো—
ইহুদিদের আর কোনো ছাড় নয়।
আর কোনো নিষ্ফল শান্তি-আলোচনাও নয়।
ইহুদিরা শান্তির ভাষা বোঝে না।
বোঝে শুধু অস্ত্রের ভাষা।
ঐক্যপুষ্ট জিহাদের ভাষা।
এই ভাষাই এখন প্রয়োগ হোক— প্রজ্ঞা আর পরিকল্পনার নিখুঁত মিশেলে।
* * *
এই লেখায় আরেকজন মানবপ্রেমিক—ফিলিস্তিনপ্রেমিক মানুষের কথা না বললে লেখাটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। তিনি তুর্কিবীর এরদোগান। বীর বলতে আমার কলম একটুও ‘না’ করছে না; বরং সতত স্বতঃস্ফূর্ততায় ‘হ্যাঁ’ বলছে।
এমন মানুষ কোথায় খুঁজে পাবো আমরা?
হে দরদি এরদোগান, আপনাকে সালাম!
আপনার অবদান কেউ ভুলতে পারবে না! না ফিলিস্তিনীরা, না আমরা!
আপনি স্বমহিমায় আরও সামনে এগিয়ে যান!
আল্লাহ আছেন আপনার সাথে!
আপনার সাথে সব ফিলিস্তিনীদের নিয়ে আলআকসায় নামায পড়ার দৃশ্যটি উপভোগ করতে আমরা সবাই অপেক্ষা করছি!
সেই বিজয়ের মহালগ্নে আপনার বিজয়ভাষণ শুনবো!
ইসমাঈল হানিয়্যার ভাষণ শুনবো!
তারপর সবাই মিলে যাবো সিরিয়ায়—সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর কবরে!
তাঁকে সালাম দিয়ে বলবো—
আপনার আমানত আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছে! আলআকসা এখন মুক্ত
Comments
Post a Comment