ঈদের নামাযে ছয় তাকবীরের দলীল



ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীর ছয়টি নাকি বারোটি-এ সম্পর্কে মাযহাবের ইমামদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম মালেক, শাফিঈ ও আহমাদ রহ.-এর মতে, ঈদের নামাযে বারো তাকবীর দিতে হবে। আর ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর মতে, উভয় ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীর ছয়টি।

ছয় তাকবীরের দলীলের আলোচনার আগে জেনে নেয়া উচিত যে, তাকবীর সংক্রান্ত ইমামদের এ ইখতিলাফ শুধুমাত্র উত্তম-অনুত্তম নিয়ে। অর্থাৎ, যারা বারো তাকবীরের কথা বলেন, তাদের মতে ছয় তাকবীর দিলেও নামায হয়ে যাবে। কিন্তু বারো তাকবীর দেয়া উত্তম। তেমনিভাবে যারা ছয় তাকবীরের কথা বলেন, তাদের মতে বারো তাকবীর দিলেও নামায হয়ে যাবে। তবে উত্তম হলো, ছয় তাকবীর দেয়া। কেননা উভয় পদ্ধতি সাহাবাদের আমল থেকে সহীহ সনদে সাব্যস্ত। তাই একটি মত গ্রহণ করলে অপরটিকে তুচ্ছজ্ঞান করা যাবে না। এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বেশ সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেন: ‘সালফে সালেহীন-এর মধ্য থেকে প্রত্যেকেই শরী‘আতসম্মত পদ্ধতিতে নামায, দু‘আ, যিকির ইত্যাদি আদায় করেছেন। আর প্রত্যেক ইমামের ছাত্রগণ ও তার দেশবাসী উক্ত ইমামের অনুসৃত পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। কখনো প্রত্যেক ইমামের অনুসৃত পদ্ধতি (জায়িয ও উত্তম হওয়ার দিক দিয়ে) এক মানের হয়, আবার কখনো কারো অনুসৃত পদ্ধতি অপরের পদ্ধতি থেকে উত্তম হয়ে থাকে ...। এমনক্ষেত্রে আমাদের অবশ্য কর্তব্য হলো, শরী‘আত সমর্থিত দলীল ছাড়া একের মতকে অন্যের মতের উপর প্রাধান্য না দেয়া। হ্যাঁ, শরী‘আতের দলীলের ভিত্তিতে যদি কোনো এক পদ্ধতি প্রাধান্য লাভ করে তবে সেটার উপর আমল করা উচিত। এতদসত্ত্বেও কেউ অন্যকোনো জায়িয পদ্ধতির অনুসরণ করলে তাকে দোষারোপ করা যাবে না।’ (আদাবুল ইখতিলাফ: ১১৪ পৃ.)

উত্তম-অনুত্তম পর্যায়ের মতানৈক্যপূর্ণ মাসআলার ক্ষেত্রে এই হলো ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর মতামত। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আমাদের আহলে হাদীস বন্ধুদের কাছে মাননীয় ও বরণীয়। তা সত্ত্বেও তারা আজ নামায-সংক্রান্ত এমন সব উত্তম-অনুত্তম পর্যায়ের ইখতিলাফ নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, যেসব ইখতিলাফ শত শত বছর পূর্বে মিটে গেছে। এসব ইখতিলাফী মাসআলা নিয়ে তারা সমাজে বিশৃঙ্ক্ষলা সৃষ্টি করছে। সরলপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ভারত উপমহাদেশ হানাফী মাযহাবের অনুসারী মুসলমানদের আবাসস্থল। এ অঞ্চলের মুসলমানদের অন্তরে হানাফী মাযহাবের বিভিন্ন হুকুম-আহকাম সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করাই বোধ হয় বর্তমান আহলে হাদীস বন্ধুদের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব। লা-মাযহাবী বন্ধুদের পক্ষ থেকে প্রোপাগান্ডার শিকার একটি মাসআলা হলো, ঈদের নামাযে ছয় তাকবীরের মাসআলা। আহলে হাদীস বন্ধুরা বলতে চায়, ঈদের নামাযে ছয় তাকবীরের পক্ষে কোনো হাদীস নেই, অথচ বারো তাকবীরের পক্ষে অনেক হাদীস আছে। তাই ঈদের নামাযে বারো তাকবীরই দিতে হবে। ছয় তাকবীর দিলে নামায হবে না।

ইনশা-আল্লাহ, আমরা ঈদের নামাযে ছয় তাকবীরের যথার্থতা উল্লেখ করে বারো তাকবীর সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলোর সমুচিত জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো, যাতে হানাফী মাযহাবের অনুসারী মুসলমান ভাইদের আস্থা হানাফী মাযহাবের উপর অটুট থাকে এবং সমাজে বিশৃঙ্ক্ষলা সৃষ্টিকারীরা আর কোনো হানাফী ভাইকে বিভ্রান্ত করতে না পারে।

জেনে নেয়া আবশ্যক যে, হাদীসের মধ্যে অতিরিক্ত ছয় তাকবীরকে বিভিন্নভাবে বোঝানো হয়েছে। কোনো হাদীসে ঈদের নামাযে নয় তাকবীর বলা হয়েছে। আবার, কোনো হাদীসে দুই রাকা‘আতে চারটি করে মোট আট তাকবীরের কথা এসেছে। কিন্তু কোনো ইমামই ঈদের নামাযে নয় বা আট তাকবীরের প্রবক্তা নন। তাহলে বোঝা গেলো, নয় বা আটের বিশেষ কোনো ব্যাখ্যা রয়েছে। মূল হাদীস উল্লেখ করার আগে সেই ব্যাখ্যা জেনে নিলে সামনের কথা বোঝা সহজ হবে।

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, ঈদের নামাযের প্রথম রাকা‘আতে তাকবীরে তাহরীমা, অতিরিক্ত তিন তাকবীর ও রুকূর তাকবীরসহ মোট তাকবীর হয় পাঁচটি। আর দ্বিতীয় রাকা‘আতে অতিরিক্ত তিন তাকবীর ও রুকূর তাকবীরসহ তাকবীর হয় চারটি। অতএব ফলাফল দাঁড়ালো ৫+৪=৯। হাদীসে যেখানেই নয় তাকবীরের কথা বলা হয়েছে, সেখানে নয়-এর ব্যাখ্যা এটাই। অর্থাৎ, দুই রাকা‘আতে অতিরিক্ত ছয় তাকবীর আর দুই রাকা‘আতের রুকূর দুই তাকবীর এবং তাকবীরে তাহরীমার এক তাকবীরসহ মোট নয় তাকবীর। আর চার চার আট তাকবীরের ব্যাখ্যা হলো, প্রথম রাকা‘আতে রুকূর তাকবীর বাদ দিয়ে অতিরিক্ত তিন তাকবীর এবং তাকবীরে তাহরীমাসহ মোট তাকবীর চারটি। আর দ্বিতীয় রাকা‘আতে রুকূর তাকবীর ও অতিরিক্ত তিন তাকবীরসহ মোট তাকবীর চারটি। ফলাফল ৪+৪=৮। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী হাদীসের যেখানেই দুই রাকা‘আতে চারটি করে আট তাকবীরের কথা বলা হয়েছে, সেখানে মূলত অতিরিক্ত ছয় তাকবীরই উদ্দেশ্য; বাকিগুলো অন্য তাকবীর। এবার আমরা সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহ উল্লেখ করছি:

1.عن القاسم ابى عبد الرحمن قال حَدَّثَنِي بَعْضُ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: صَلَّى بِنَا , النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عِيدٍ , فَكَبَّرَ أَرْبَعًا , وَأَرْبَعًا , ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ حِينَ انْصَرَفَ , قَالَ: «لَا تَنْسَوْا , كَتَكْبِيرِ الْجَنَائِزِ , وَأَشَارَ بِأَصَابِعِهِ , وَقَبَضَ إِبْهَامَهُ» فَهَذَا حَدِيثٌ , حَسَنُ الْإِسْنَادِ.

অর্থ: ‘প্রসিদ্ধ তাবেঈ আবূ আব্দুর রহমান কাসিম রহ. বলেন, আমাকে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একজন সাহাবী (রা) হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি রা. বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন আমাদের নামায পড়ান এবং চারটি করে তাকবীর দেন। নামায শেষে আমাদের দিকে তাকিয়ে ইরশাদ করেন, ভুলো না যেনো। তারপর হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল বন্ধ করে বাকি চার অঙ্গুলি দিয়ে ইশারা করে বললেন, জানাযার তাকবীরের মতো (ঈদের নামাযেও প্রতি রাকা‘আতে চারটি করে তাকবীর) । ইমাম তহাবী রহ. এ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। (তহাবী দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৩৭১, হা. নং ৭১২৯)

2- عَنْ مَكْحُولٍ، قَالَ: أَخْبَرَنِي أَبُو عَائِشَةَ، جَلِيسٌ لِأَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ سَعِيدَ بْنَ الْعَاصِ، سَأَلَ أَبَا مُوسَى الْأَشْعَرِيَّ، وَحُذَيْفَةَ بْنَ الْيَمَانِ، كَيْفَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُكَبِّرُ فِي الْأَضْحَى وَالْفِطْرِ؟ فَقَالَ أَبُو مُوسَى: «كَانَ يُكَبِّرُ أَرْبَعًا تَكْبِيرَهُ عَلَى الْجَنَائِزِ»، فَقَالَ حُذَيْفَةُ: صَدَقَ، فَقَالَ أَبُو مُوسَى: «كَذَلِكَ كُنْتُ أُكَبِّرُ فِي الْبَصْرَةِ، حَيْثُ كُنْتُ عَلَيْهِمْ»، وَقَالَ أَبُو عائِشَةَ: «وَأَنَا حَاضِرٌ سَعِيدَ بْنَ الْعَاصِ»سنن ابى داؤد

অর্থ: ‘প্রসিদ্ধ তাবেঈ ইমাম মকহুল দামেস্কী বলেছেন, আমাকে আবূ হুরাইরা রা.-এর একজন সঙ্গী আবূ আয়িশা আল উমাবী জানিয়েছেন যে, (কূফার আমীর) সাঈদ ইবনুল ‘আস, আবূ মূসা আশআরী ও হুযাইফা ইবনে ইয়ামান রা.কে জিজ্ঞেস করেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরে কয় তাকবীর দিতেন? আবূ মূসা রা. উত্তরে বললেন, একেক রাকা‘আতে জানাযার তাকবীরের সমসংখ্যক (চার) তাকবীর দিতেন। হুযাইফা রা. আবূ মূসা রা.কে সমর্থন করে বললেন, তিনি ঠিক বলেছেন। আবূ মূসা রা. আরো বললেন, আমি যখন বসরার আমীর ছিলাম, তখন আমি সেখানে এভাবে প্রতি রাকা‘আতে চার তাকবীর দিতাম। আবূ আয়িশা বলেন, সাঈদ ইবনুল ‘আসের এ প্রশ্নের সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। (সুনানে আবূ দাউদ: ১/১৬৩, হা. নং ১১৫৩, মুসনাদে আহমাদ: ৪/৪১৬, হা. নং ১৭৭৩৪। সনদের বিবেচনায় হাদীসটি হাসান পর্যায়ের। হাদীসটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা জানতে ‘আসারুস সুনান: ৩১৫ পৃ. টীকা দ্রষ্টব্য। আর চার তাকবীরের উদ্দেশ্য ও ব্যাখ্যা যে তিন তাকবীর, তা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।)

3. عَنْ كُرْدُوسٍ، قَالَ: «كَانَ عَبْدُ اللهِ بْنُ مَسْعُودٍ يُكَبِّرُ فِي الْأَضْحَى، وَالْفِطْرِ تِسْعًا تِسْعًا، يَبْدَأُ فَيُكَبِّرُ أَرْبَعًا، ثُمَّ يَقْرَأُ ثُمَّ يُكَبِّرُ وَاحِدَةً فَيَرْكَعُ بِهَا، ثُمَّ يَقُومُ فِي الرَّكْعَةِ الْآخِرَةِ فَيَبْدَأُ فَيَقْرَأُ، ثُمَّ يُكَبِّرُ أَرْبَعًا يَرْكَعُ بِإِحْدَاهُنَّ» رواه الطبرانى فى الكبير(9513)و قال الهيثمى: رواه الطبرانى فى الكبير ورجاله ثقات.

অর্থ: ‘বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত কুরদূস রহ. বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের নামাযে নয়টি করে তাকবীর দিতেন। নামায শুরু করে চারটি তাকবীর দিতেন (তিনটি অতিরিক্ত আর একটি তাহরীমার), তারপর ক্বিরা‘আত পড়তেন। অতঃপর এক তাকবীর বলে রুকূ করতেন। এরপর দ্বিতীয় রাকা‘আতে দাঁড়িয়ে ক্বিরা‘আত পড়ে আবারো মোট চারটি তাকবীর দিতেন যার একটি দিয়ে রুকূ করতেন।’ (আল-মু’জামুল কাবীর, হা. নং ৯৫১৩) এ হাদীস সম্পর্কে হাফেজে হাদীস আল্লামা হাইছামী রহ. বলেন, হাদীসটির সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য।

অতএব, হায়ছামী রহ.-এর উক্তি অনুযায়ী হাদীসটি সহীহ। আর আল্লামা নিমাভী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। কিন্তু এতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ, হাসান ও সহীহ উভয় প্রকারের হাদীসই আমলের ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের গ্রহণযোগ্য।

4. عن علقمة والاسود قالا: كَانَ ابْنُ مَسْعُودٍ جَالِسًا وَعِنْدَهُ حُذَيْفَةُ وَأَبُو مُوسَى الْأَشْعَرِيُّ، فَسَأَلَهُمَا سَعِيدُ بْنُ الْعَاصِ عَنِ التَّكْبِيرِ فِي الصَّلَاةِ يَوْمَ الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى فَجَعَلَ هَذَا يَقُولُ: سَلْ هَذَا، وَهَذَا يَقُولُ: سَلْ هَذَا، فَقَالَ لَهُ حُذَيْفَةُ: سَلْ هَذَا ـ لِعَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ ـ فَسَأَلَهُ، فَقَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ: «يُكَبِّرُ أَرْبَعًا ثُمَّ يَقْرَأُ، ثُمَّ يُكَبِّرُ فَيَرْكَعُ، ثُمَّ يَقُومُ فِي الثَّانِيَةِ فَيَقْرَأُ، ثُمَّ يُكَبِّرُ أَرْبَعًا بَعْدَ الْقِرَاءَةِ»

অর্থ: ‘আলক্বামা ও আসওয়াদ রহ. বলেছেন, একদা ইবনে মাসঊদ, হুযাইফা ও আবূ মূসা আশআরী রা. বসেছিলেন। তখন সাঈদ ইবনুল ‘আস তাদের নিকট ঈদের নামাযে তাকবীরের সংখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে হুযাইফা রা. বললেন, আশআরী ভাইকে জিজ্ঞেস করো। আর আবূ মূসা আশআরী রা. বললেন, ইবনে মাসঊদ রা.কে জিজ্ঞেস করো, কেননা তিনি আমাদের মধ্যে প্রবীণ ও বেশি ইলমের অধিকারী। সর্বশেষে সাঈদ ইবনুল ‘আস, ইবনে মাসঊদ রা.কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, নামায শুরু করে চারটি তাকবীর দিবে (তাকবীরে তাহরীমা ও অতিরিক্ত তিনটি), তারপর ক্বিরা‘আত পড়ে তাকবীর দিয়ে রুকূতে যাবে। অতঃপর দ্বিতীয় রাকা‘আতে দাঁড়িয়ে প্রথমে ক্বিরা‘আত পড়বে, তারপর চারটি তাকবীর দেবে (অতিরিক্ত তাকবীর তিনটি আর রুকূর একটি)। (মুহাল্লা বিল আসার: ৩/২৯৫, ইবনে হাযাম যাহেরী ও নিমাভী রহ. এ হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন। মুসান্নাাফে আব্দুর রাযযাক হা. নং ৫৬৮৭, আসারুস সুনান : পৃ. ৩১৫)

5. عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الْحَارِثِ هُوَ ابْنُ نَوْفَلٍ - قَالَ: كَبَّرَ ابْنُ عَبَّاسٍ يَوْمَ الْعِيدِ فِي الرَّكْعَةِ الْأُولَى أَرْبَعَ تَكْبِيرَاتٍ ثُمَّ قَرَأَ ثُمَّ رَكَعَ، ثُمَّ قَامَ فَقَرَأَ ثُمَّ كَبَّرَ ثَلَاثَ تَكْبِيرَاتٍ سِوَى تَكْبِيرَةِ الصَّلَاةِ (اخرجه ابن حزم الظاهرى فى المحلى بالاثار 295/3 دارالكتب . وقال فى سند هذا الاثر و الاثر الذى قبله: هذان اسنادان فى غاية الصحة.

অর্থ: আব্দুল্লাহ বিন হারেস বিন নাওফেল বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ঈদের দিন তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া প্রথম রাকা‘আতে চারটি তাকবীর দেন (অতিরিক্ত তিনটি ও রুকূর একটি) । অতঃপর ক্বিরা‘আত পড়েন, এরপর রুকূ করেন। দ্বিতীয় রাকা‘আতে দাঁড়িয়ে প্রথমে ক্বিরা‘আত পড়লেন, এরপর নামাযের অন্যান্য তাকবীর ছাড়া অতিরিক্ত তিনটি তাকবীর দিলেন।’ ইবনে হাযাম রহ. এ হাদীস এবং এর পূর্বে বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে বলেন, ‘এই উভয় হাদীসের সনদ খুব সহীহ। ইমাম আবূ হানীফা রহ. এ হাদীস দ্বারাই দলীল দেন।’ (মুহাল্লা বিল আসার: ৩/২৯৫)

6. اخرج ابن ابى شيبة حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ، عَنْ أَشْعَثَ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ، عَنْ أَنَسٍ «أَنَّهُ كَانَ يُكَبِّرُ فِي الْعِيدِ تِسْعًا»

অর্থ: ‘ইবনে আবী শাইবা, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান থেকে, তিনি আশআছ থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হযরত আনাস রা. ঈদের নামাযে মোট নয় তাকবীর দিতেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ১/৪৯৫, হা. নং ৫৭৬০, খ: ৪, পৃ. ২১৭)

এ আসারের রাবী ইবনে আবী শাইবা, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল-কাত্তান এবং মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন সকলেই সুপ্রসিদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস। আর আশআছ সম্পর্কে ইমাম জামালুদ্দীন মিয্যী রহ. বলেন:

هواشعث بن عبد الملك, قال يحيى بن سعيد: هو عندى ثقة مامون, وقال ابن
معين: اشعث ثقة وكذالك قال النسائى, وقال ابوحاتم: لابأس به.

অর্থ: ‘তার পিতার নাম আব্দুল মালেক। ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ রহ. তার সম্পর্কে বলেন, তিনি আমার মতে নির্ভরযোগ্য ও আস্থাশীল। ইবনে মাঈন রহ. বলেন, আশআছ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, ইমাম নাসাঈও তার সম্পর্কে একই মন্তব্য করেছেন। আর ইমাম আবূ হাতেম রহ. বলেছেন, (হাদীসের ক্ষেত্রে) তার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। (তাহযীবুল কামাল: ২/২৭৯)

উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ হাদীসটিও সহীহ।

7- أخرج ابن أبي شيبة عن  أَبِى أُسَامَةَ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي عَرُوبَةَ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، وَسَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، قَالَا: «تِسْعُ تَكْبِيرَاتٍ، وَيُوَالِي بَيْنَ الْقِرَاءَتَيْنِ»

অর্থ: ‘হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. এবং সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব রহ. (তিনি তাবেঈদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ) বলেন, ঈদের নামাযে মোট নয়টি তাকবীর হবে। আর উভয় রাকা‘আতে ক্বিরা‘আত অবিচ্ছিন্ন ধারায় হবে। (অর্থাৎ উভয় রাকা‘আতের ক্বিরা‘আতের মাঝে কোনো অতিরিক্ত তাকবীর হবে না।) (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ৪/২১৬, হা. নং ৫৭৫৬০)

এ হাদীসের রাবী সাঈদ ইবনে আবী আরুবা এবং ক্বাতাদাহ সুপ্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। আর আবূ উসামা সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রহ. বলেছেন, ‘তিনি শীর্ষস্থানীয়দের একজন’। ইমাম আহমাদ ও ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেছেন, ‘তিনি নির্ভরযোগ্য’। (সিয়ারু আ’লামিননুবালা: ৮/১৭৬) অতএব, এ হাদীসটির সনদও সহীহ।

8. عن عبد الله بن الحارث قال: شَهِدْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ «كَبَّرَ فِي صَلَاةِ الْعِيدِ بِالْبَصْرَةِ تِسْعَ تَكْبِيرَاتٍ، وَالَى بَيْنَ الْقِرَاءَتَيْنِ» قَالَ: وَشَهِدْتُ الْمُغِيرَةَ بْنَ شُعْبَةَ فَعَلَ ذَلِكَ أَيْضًا.

অর্থ: তাবেঈ হযরত আব্দুল্লাহ বিন হারেস বর্ণনা করেন যে, আমি বসরায় ইবনে আব্বাস রা.কে ঈদের নামাযে মোট নয়টি তাকবীর দিতে দেখেছি এবং তিনি উভয় রাকা‘আতের ক্বিরা‘আত অবিচ্ছিন্নভাবে আদায় করেছেন। আর মুগীরা বিন শু’বাহ রা.কেও আমি এরূপ করতে দেখেছি। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৩/২৯৪, হা. নং ৫৬৮৭; হাফেজ ইবনে হাজার আসকলানী রহ. এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন, দেরায়া: ১/১১০)

উল্লেখ্য, এ উভয় হাদীসে নয় তাকবীরের মধ্যে ছয়টি অতিরিক্ত, আর তিনটি নামাযের স্বাভাবিক তাকবীর, যা শুরুতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ঈদের নামাযে ছয় তাকবীর সম্পর্কে আরো কিছু আসার পাওয়া যায়। আলোচনা সংক্ষেপ-করণার্থে আমরা এখানে সেগুলো উল্লেখ করলাম না। তবে যেসব সাহাবায়ে কিরাম রা. থেকে ছয় তাকবীরের আমল সহীহ সনদে প্রমাণিত তাদের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হলো:

১.হযরত উমর রা. (শরহু মাআনিল আসার: ১/৩১৯)

২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা.

৩. হযরত আনাস ইবনে মালেক রা.

৪. হযরত আবূ মূসা আশআরী রা.

৫. হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা.

৬. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.

৭. হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান রা.

৮. হযরত মুগীরা ইবনে শু’বাহ রা.

৯. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৩/২৯১, হা. নং ৫৬৭৬)

১০. হযরত বারা ইবনে আযেব রা.

১১. হযরত হাজ্জাজ ইবনে মালেক রা.

১২. হযরত আবুত তুফায়েল আমের ইবনে ওয়াসেলা রা.

১৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ রা.

১৪. হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রা.

১৫. হযরত আবূ রাফে রা.

১৬. হযরত আবূ উমাম আল বাহেলী রা.

বি.দ্র. ১০-১৬ পর্যন্ত সাহাবায়ে কিরাম রা. হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা.-এর শাগরিদ। আর ইবরাহীম নাখয়ী রহ. থেকে সহীহ সনদে সাব্যস্ত রয়েছে যে, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা.-এর শাগরিদগণ ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তাকবীর দিতেন।’ (দেখুন, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ৪/২২০, হা. নং ৫৭৬১)

বিশিষ্ট যেসব তাবেঈ হযরত ছয় তাকবীরের উপর আমল করতেন:

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. থেকে বর্ণিত, তাবেঈদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তিনজন:

১. সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব রহ.

২. আলক্বামা বিন কায়েস রহ.

৩. আসওয়াদ বিন ইয়াযীদ রহ. (আততাকয়ীদ ওয়াল ঈযাহ: পৃ. ২৫৫)।

এ তিনজনই ছয় তাকবীরের উপর আমল করতেন।

৪. ক্বাতাদাহ বিন দিআমা রহ.

৫. আবূ কিলাবা রহ.

৬. আবূ জা’ফর রহ. (দেখুন মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ৪/২১৭, হা. নং ৫৭৬২, ৫৭৬৩; শায়েখ আওয়ামার তাহকীক)। এরাও অনুরূপ আমল করেন।

মারফূ হাদীস, আসারে সাহাবা এবং আসারে তাবেঈন দ্বারা একথা প্রমাণিত হয়ে গেলো যে, ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তাকবীরের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য সনদে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরাম রা. থেকে প্রমাণিত। এতদসত্ত্বেও যারা ছয় তাকবীর নিয়ে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তারা মূলত মুসলিম সমাজে অনৈক্য, অশান্তি ও বিশৃঙ্ক্ষলা সৃষ্টির কাজে ইহুদী-খ্রিস্টানদেরকে সাহায্য করছে। এছাড়া অন্যকোনো উদ্দেশ্য আমাদের বুঝে আসে না। আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন।

বারো তাকবীরের পক্ষে লা-মাযহাবী বন্ধুরা যেসব হাদীস পেশ করে থাকেন সেগুলোর পর্যালোচনা:

1. عَنْ كَثِيرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَبَّرَ فِي العِيدَيْنِ فِي الأُولَى سَبْعًا قَبْلَ القِرَاءَةِ، وَفِي الآخِرَةِ خَمْسًا قَبْلَ القِرَاءَةِ.

অর্থ: কাসীর ইবনে আব্দুল্লাহ স্বীয় সূত্রে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় ঈদের প্রথম রাকা‘আতে ক্বিরা‘আতের পূর্বে সাত তাকবীর দিতেন এবং দ্বিতীয় রাকা‘আতে ক্বিরা‘আতের পূর্বে পাঁচ তাকবীর দিতেন। (সুনানে তিরমিযী: ১/১১১, হা. নং ৫৩৬)

আমাদের কথা: এ হাদীসটি কাসীর বিন আব্দুল্লাহ রহ.-এর সূত্রে বর্ণিত। আমরা কাসীর বিন আব্দুল্লাহ সম্পর্কে রিজাল শাস্ত্রবিদ ইমামদের মন্তব্য তুলে ধরছি। যাতে বোঝা যায় যে, তার হাদীস গ্রহণযোগ্য কি-না?

ইমাম আহমাদ রহ. কাসীর সম্পর্কে বলেন, منكر الحديث، ليس بشيء.  ‘তার হাদীস প্রত্যাখ্যাত, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।’ রিজাল শাস্ত্রের আরেক দিকপাল ইয়াইইয়া বিন সাঈদ আল কাত্তানও তার সম্পর্কে ليس بشيء. বলে মন্তব্য করেছেন। ইমাম শাফিঈ কাসীর সম্পর্কে বলেছেন, ذاك أحد الكذابين. ‘সে একজন মিথ্যুক।’ ইমাম আবূ যুরআহ বলেছেন, واهي الحديث، ليس بقوي. ‘সে মনগড়া হাদীস বয়ান করে, আর সে অতি-দুর্বল বর্ণনাকারী’। ইমাম নাসাঈ ও দারাকুতনী রহ. বলেছেন, متروك الحديث. ‘তার হাদীস পরিত্যাজ্য।’ (দেখুন তাহযীবুত তাহযীব: ৬/৫৫৮)

হাদীস বিশারদ ও রিজাল শাস্ত্রবিদ ইমামগণের মন্তব্য দ্বারা একথা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, কাসীর বিন আব্দুল্লাহ একজন অগ্রহণযোগ্য রাবী। তার সূত্রে বর্ণিত হাদীস প্রমাণের উপযুক্ত নয়। অতএব, এ হাদীসটি বারো তাকবীর প্রমাণের উপযুক্ত নয়।

2.عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه أنه صَلّٰى صَلَاةَ الْعِيْدِ فَكَبَّرَ فِيْ الْأُوْلٰى سَبْعًا وَ فِي الثَّانِيَةِ خَمْسًا يَرْفَعُ يَدَيْهِ مَعَ كُلِّ تَكْبِيْرَةٍ. (سنن البيهقي ৩/৪১২)

অর্থ: হযরত উমর রা. সম্পর্কে বর্ণিত যে, তিনি ঈদের নামায পড়ার সময় প্রথম রাকা‘আতে সাত তাকবীর দিলেন, আর দ্বিতীয় রাকা‘আতে পাঁচ তাকবীর দিলেন এবং প্রত্যেক তাকবীরের সময় হাত উঠালেন। (সুনানে বাইহাকী: ৩/৪০৮, হা. নং ৬১৮২)

আমাদের কথা: হযরত উমর রা.-এর আমল সম্পর্কে বর্ণিত এ আসারের সনদে ইফরীকী নামক একজন রাবী রয়েছেন, যার মূল নাম আব্দুর রহমান বিন যিয়াদ বিন আনউম। এই ইফরীকী সম্পর্কে আলী ইবনুল মাদীনী রহ. বলেছেন, ضعف يحيى الإفريقي. ‘ইয়াহইয়া বিন সাঈদ রহ. ইফরীকীকে যঈফ বলেছেন।’ আর আব্দুর রহমান বিন মাহদী ইফরীকী সম্পর্কে বলেছেন, أما الإفريقي فما ينبغي أن يروى الحديث عنه. ‘আর ইফরীকী, সে তো এমন যে, তার থেকে একটি হাদীসও বর্ণনা করা উচিত নয়।’ ইমাম আহমাদ তার সম্পর্কে বলেছেন, ليس بشيء ‘তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।’ ইমাম নাসাঈ তাকে ‘যঈফ’ বলেছেন। (তাহযীবুত তাহযীব: ৫/৮৬) হাদীস শাস্ত্রের এসব বিদগ্ধ ইমামদের মন্তব্য দ্বারা সাব্যস্ত হলো যে, ইফরীকী একজন ‘যঈফ’ রাবী। অতএব, তার সূত্রে বর্ণিত হযরত উমর রা.-এর আমল সম্পর্কীয় আসারটি দলীলযোগ্য হতে পারে না।

তাছাড়া, হযরত উমর রা. থেকে ঈদের নামাযে ছয় তাকবীরের উপর আমল সুপ্রমাণিত। ইমাম তহাবী রহ. বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইন্তিকালের পর এ নিয়ে মতভেদ দেখা দিলো যে, জানাযার নামাযে তাকবীর সংখ্যা কতো হবে? চার, পাঁচ, নাকি সাতটি? এ মতভেদ নিরসনে হযরত উমর রা. নিজ খিলাফতকালে সাহাবায়ে কিরামকে একত্র করে বললেন, ‘আপনারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী। কোনোবিষয়ে আপনাদের মতৈক্য, বা মতানৈক্য পরবর্তীদের মধ্যে মতৈক্য, বা মতানৈক্য সৃষ্টি করবে। তার একথা শুনে উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম বললেন, আমীরুল মু’মিনীন আপনি ঠিক বলেছেন। আলোচিত বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত আমাদেরকে বলুন। উমর রা. বললেন, বরং আপনারা আপনাদের মতামত বলুন। কেননা আমিও আপনাদের মতোই একজন মানুষ। এরপর সাহাবায়ে কিরাম পরস্পর মতবিনিময় করলেন এবং এ বিষয়ে একমত হলেন যে, যেভাবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায় চার চার তাকবীর হয়ে থাকে, সেভাবে জানাযার নামাযেও চার তাকবীর হবে। (শরহু মাআনিল আসার: ১/৩১৯)

বি.দ্র. উল্লেখ্য যে, ঈদ ও জানাযার তাকবীরের ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিভিন্ন রকম আমল পাওয়া যায়। তবে এ কথা ঠিক যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শেষ আমল ছিলো চার চার তাকবীর, যে চারটির তিনটি অতিরিক্ত হবে। এজন্যই এ ব্যাপারে সকলে একমত হয়ে গেলেন।

উপরিউক্ত হাদীস দ্বারা একথা বোঝা গেলো যে, ঈদের নামাযে প্রথম রাকা‘আতে তাকবীরে তাহরীমাসহ চার তাকবীর হওয়া একটি স্বীকৃত বিষয় ছিলো। যে কারণে জানাযার তাকবীরের সমাধান ঈদের তাকবীরের সাথে তুলনা করে করা হলো। এ ঘটনা দ্বারা একথাও বুঝে আসে যে, হযরত উমর রা.সহ ঐ মাজলিসে উপস্থিত সকল সাহাবায়ে কিরামই দুই ঈদে ছয় তাকবীরের প্রবক্তা ছিলেন।

অতএব, হযরত উমর রা. থেকে বারো তাকবীর বিষয়ক বর্ণিত আসার সম্পর্কে আমরা একথা বলতে পারি যে, দুই কারণে উক্ত আসার গ্রহণযোগ্য নয়। (১) এ আসারের রাবী ইফরীকী যঈফ, এবং (২) হযরত উমর রা. থেকে দুই ঈদে ছয় তাকবীর প্রমাণিত।

3. عَنْ عَائِشَةَ، " أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُكَبِّرُ فِي الْعِيدَيْنِ سَبْعًا، وَخَمْسًا قَبْلَ الْقِرَاءَةِ ".

অর্থ: হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় ঈদের নামাযে ক্বিরা‘আতের পূর্বে সাতটি ও পাঁচটি করে তাকবীর দিতেন। (মুসনাদে আহমাদ: ৪/৪২২, হা. নং. ২৪৩৬২)

4.عن عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، قَالَ: قَالَ نَبِيُّ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «التَّكْبِيرُ فِي الْفِطْرِ سَبْعٌ فِي الْأُولَى، وَخَمْسٌ فِي الْآخِرَةِ، وَالْقِرَاءَةُ بَعْدَهُمَا كِلْتَيْهِمَا»

অর্থ: হযরত ‘আমর ইবনুল ‘আস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ঈদুল ফিতরের প্রথম রাকা‘আতে সাত তাকবীর, আর দ্বিতীয় রাকা‘আতে পাঁচ তাকবীর। উভয় রাকা‘আতে তাকবীরের পরেই ক্বিরা‘আত। (সুনানে আবূ দাউদ: ১/১৬৩, হা. নং ১১৫১)

৩ ও ৪ নং হাদীস সম্পর্কে আমাদের কথা: গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের অনুসৃত ইমাম ইবনে হাযাম রহ. স্বীয় কিতাব মুহাল্লা বিল আসার-এ হযরত আয়িশা রা. ও ‘আমর ইবনুল ‘আস রা. থেকে বর্ণিত হাদীস দুটি উল্লেখ করার পর বলেন, وهذا كله لا يصح. ‘এ দু’টির একটিও সহীহ নয়’। (দেখুন, মুহাল্লা বিল আসার: ৩/২৯৬)

তাছাড়া, হযরত আয়িশা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিকে বুখারী রহ.ও যঈফ আখ্যা দিয়েছেন । (প্রাগুক্ত টীকা দ্রষ্টব্য।) আর ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ হাকেম মনিশাপুরী রহ. এ উভয় হাদীসের সনদকে ‘ফাসেদ’ বলেছেন এবং ইমাম যাহাবী রহ. তা সমর্থন করেছেন। (দেখুন, আল মুস্তাদরাক: ১/২৯৮, হা. নং ২০৬)

5.عن نافع أنه قال: شَهِدْتُ الْأَضْحَى وَالْفِطْرَ مَعَ أَبِي هُرَيْرَةَ. فَكَبَّرَ فِي الرَّكْعَةِ الْأُولَى سَبْعَ تَكْبِيرَاتٍ قَبْلَ الْقِرَاءَةِ. وَفِي الآخِرَةِ خَمْسَ تَكْبِيرَاتٍ (1) قَبْلَ الْقِرَاءَةِ.

অর্থ: নাফে রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ হুরাইরা রা.-এর সাথে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা পড়েছি। তিনি প্রথম রাকা‘আতে ক্বিরা‘আতের পূর্বে সাত তাকবীর দিলেন, আর দ্বিতীয় রাকা‘আতে ক্বিরা‘আতের পূর্বে পাঁচ তাকবীর দিলেন। (মুআত্তা ইমাম মালেক: ১/২৩৯)

আমাদের কথা: আবূ হুরাইরা রা.-এর আমল সম্পর্কীয় এ আসারটির সনদ সহীহ। এই একটিমাত্র আসার ছাড়া বারো তাকবীর সম্পর্কীয় অন্যসব মারফূ এবং গাইরে মারফূ হাদীস যঈফ তথা প্রমাণযোগ্য নয়। ইমাম আহমাদ রহ. বারো তাকবীরের প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও বলেছেন,

لَيْسَ يُرْوٰى عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ فِيْ تَكْبِيْرِ الْعِيْدَيْنِ حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ.

অর্থ: ‘ঈদের নামাযে তাকবীর সংখ্যা সম্পর্কে কোনো সহীহ মারফূ হাদীস নেই।’ (নসবুর রায়াহ: ৩/২৮৯। উল্লেখ্য, ছয় তাকবীরের পক্ষে উল্লিখিত মারফূ হাদীসগুলো হাসান পর্যায়ের। অতএব, ইমাম আহমাদ রহ.-এর একথা দ্বারা আমাদের দলীল খণ্ডন হয় না।)

এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বোঝার রয়েছে, যথা:

(ক) আবূ হুরাইরা রা.-এর আমলটি স্বয়ং নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুস্পষ্ট ঘোষণা ও হুকুমের খেলাফ (আমাদের দলীলের ১ম হাদীস দেখুন) । আর নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর হুকুমের বরখেলাফ কোনো সাহাবীর আমল গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, হতে পারে ঐ বিষয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হুকুম তিনি জানতে পারেননি। এমন অনেক ঘটনা হাদীসের কিতাবে বিদ্যমান।

(খ) অথবা, কোনো এক যামানায় নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারো তাকবীরে ঈদের নামায পড়িয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তা তরক করে ছয় তাকবীরে ঈদের নামায পড়িয়েছেন। আর এ খবর হযরত আবূ হুরাইরা রা.-এর নিকট পৌঁছেনি। তাই তিনি প্রথম যুগের বারো তাকবীরের উপর আমল করেছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সর্বশেষ আমল জানা থাকলে কখনো তিনি তার খেলাফ করতেন না।

(গ) আবূ হুরাইরা রা.-এর আমলটি বড় বড় সাহাবায়ে কিরামের আমলের খেলাফ। এমতাবস্থায় বড় বড় সাহাবার আমল বাদ দিয়ে শুধু তার একার আমল গ্রহণ করা উচিত হবে না।

(ঘ) সর্বোপরি, এই তাকবীরগুলো নামাযের মূল অংশ নয়, বরং অতিরিক্ত অংশ। আর শরী‘আতের নীতি হলো, অতিরিক্ত বিষয় নামাযে দাখিল করতে হলে তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হতে হবে।

যা-হোক, ছয় ও বারো তাকবীরের ইখতিলাফের মধ্যে ছয় তাকবীর নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত। যারা বারো তাকবীরের কথা বলেন, তারাও ছয় তাকবীরকে মানেন। কেননা, বারোর মধ্যে ছয় আছে। কিন্তু বারো তাকবীরের বিষয়টি এমন নয়। কারণ, বারো তাকবীরকে সকলে স্বীকার করে না। বরং ছয় তাকবীরের প্রবক্তাগণ প্রকারান্তরে বারো তাকবীরকে অস্বীকার করেন। অতএব, অনিশ্চিত বিষয়কে নামাযের মধ্যে দাখিল করা উচিত হবে না। তাই আমরা একথা বলতে পারি যে, হানাফীদের আমল সকল দিক বিবেচনায় মজবুত এবং সহীহ।


Comments

Popular posts from this blog

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ