ইসলামী বিশ্বকোষে ফুরফুরা সিলসিলার হযরত মোজাদ্দেদে জামান আবু বকর সিদ্দিক (রহ.)

ইসলামী বিশ্বকোষে ফুরফুরা সিলসিলার হজরত মোজাদ্দেদে জামান
আবু বকর সিদ্দিক (রহ.)
===================================================

[ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বাংলাভাষাভাষীদের জন্য ২৫ খন্ডে প্রায় বিশ হাজার পৃষ্ঠার বিস্তারিত ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই বিশ্বকোষের ২য় খণ্ডে ১১৮ -১২০ পৃষ্ঠায় মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.)শিরোনামে মোজাদ্দেদে জামান (রহ.)-এর উপর অত্যন্ত তথ্যবহুল ও সারগর্ভ নিবন্ধ সংযোজিত হয়েছে। বিশ্বকোষের পাতা থেকে উক্ত নিবন্ধটি হুবহু নীচে তুলে ধরা হল- ]

মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.)
=========================
মাওলানা শাহ আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) হুগলী জেলার ফুরফুরায় জন্মগ্রহণ করেন।
 [জন্ম সন সম্বন্ধে মতভেদ আছেঃ সন ১২৫৩, বাংলা সংসদ, বাঙালী চরিতাভিধান, প্রধান সম্পাদক, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৭৬ খৃঃ, পৃঃ ৪৩; সন ১২৬৫ বাংলা, এম ওবাইদুল হক, বাংলাদেশের পীর আউলিয়াগণ ফেনী, ১৯৬৯ খৃঃ, পৃঃ ৩৫; সন ১২৬৩ হিঃ, মুহাম্মদ মুতীউর রহমান, আঈনা-ই-ওয়ায়সী, পাটনা, ১৯৭৬ খৃঃ, পৃঃ ২৪২; দেওয়ান মুহাম্মদ ইব্রাহীম তর্কবাগীশ, হাকীকতে ইনসানিয়াত, রাজশাহী, ১৩৯০, হিঃ, পৃঃ ৩]।

 তিনি প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিকী (রা.)-এর বংশধর। তাঁর এক পূর্ব পুরুষ মানসুর বাগদাদী ৭৪১/১৩৪০ সালে বঙ্গদেশে আসেন এবং হুগলী জেলার মোল্লাপাড়া গ্রামে বাস করেন (ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ইসলাম প্রসঙ্গ, ঢাকা, ১৯৬৩ খৃঃ, পৃঃ ১১৭-২৬)।

 মানসুর বাগদাদীর অধস্তন অষ্টম পুরুষ মুস্তফা মাদানী ছিলেন শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.), (মৃঃ ১০৩৪/১৬২৪)-এর তৃতীয় পুত্র মাসুম রাব্বানীর মুরিদ। কথিত আছে, মাসুম রাব্বানীর অন্যতম মুরিদ ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব (মৃঃ ১১১৮/১৭০৭)। তিনি মুস্তফা মাদানীকে মেদিনীপুর শহরে একটি মসজিদ সংলগ্ন মহল ও বহু লা-খারাজ (নিস্কর) সম্পত্তি দান করেছিলেন (ইসলাম প্রসঙ্গ)।

হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকীর বয়স যখন মাত্র নয় মাস, তখন তাঁর পিতা আবদুল মুক্তাদীর (রহ.) এন্তেকাল করেন (১২৬৬ ব.)। তাঁর মাতা মাহাব্বাতুন নিসার আগ্রহে ও যত্নে তিনি প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন।

 তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। সিতাপুর মাদ্রাসা ও পরে হুগলী মুহসিনিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যয়ন করেন। শেষোক্ত মাদ্রাসা হতে তিনি কৃতিত্বের সাথে জামাআতে উলা (ফাজিল) পাশ করেন। অতঃপর তিনি কলকাতা সিন্ধরিয়া পট্টির মসজিদে হাফিজ জামালুদ্দীন-এর নিকট তাফসীর হাদীস ও ফিকহ অধ্যয়ন করেন। হাফিজ সাহেব শহীদ সায়্যিদ আহমাদ বেরেলবী (রহ.) (মৃঃ ১২৪৬/১৮৩১)-এর খলিফা ছিলেন। কলকাতা নাখোদা মসজিদে মাওলানা বিলায়াত (রহ.)এর নিকট তিনি মানতিক, হিকমা (গ্রীক বিজ্ঞান) ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ২৩/২৪ বৎসর বয়সে তিনি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। অতঃপর তিনি মদীনা শরীফ গমন করেন। তথায় হাদীস অধ্যয়ন করেন এবং রওজা মুবারক-এর খাদেম বিখ্যাত আলেম আদ-দালাইল আমীন রিদওয়ান-এর নিকট হতে ৪০টি হাদীস গ্রন্থের সনদ লাভ করেন। (হাকীকতে ইনসানিয়াত পৃঃ ৪; বাংলাদেশের পীর আউলিয়াগণ পৃঃ ৩৬; আবু ফাতেমা মোহাম্মদ ইসহাক, ফুরফুরার পীর হযরত আবু বকর সিদ্দিকী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৯৮০, পৃঃ ১০-১১)

তৎপর দেশে প্রত্যাবর্তন করে একাধিক্রমে ১৮ বছর তিনি ব্যক্তিগতভাবে অধ্যয়ন ও গবেষনা করেন। (ফুরফুরার পীর হযরত আবু বকর সিদ্দিকী পৃঃ ১১)

পাঠ্যাবস্থাতেই ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। রাত জেগে তিনি জিকির করতেন। শরিয়তের হুকুম-আহকাম সাধ্যমত পালন করতে তিনি অতিশয় যত্নবান ছিলেন। এভাবে যখন তিনি নিরলস সাধনায় রত ছিলেন, তখন কলকাতায় বিখ্যাত ওলী শাহ সুফি ফতেহ আলী (রহ.) (মৃঃ ১৩০৪/১৮৮৬)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) তাঁর নিকট বায়আত গ্রহণ করেন এবং নিষ্ঠার সাথে ইলম-ই-মারিফত শিক্ষা করেন। তিনি সুফি ফতেহ (রহ.)-এর একজন প্রধান খলিফা ছিলেন। ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। বিভিন্ন ফিকহী মাসআলার সঠিক উত্তর জিজ্ঞেস করা মাত্রই তিনি কেতাব না দেখে বলে দিতেন। কথিত আছে, স্বপ্নে তিনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট কিছু দীনি মাসআলা শিক্ষা করেছিলেন (বাংলাদেশের পীর-আউলিয়াগণ, পৃঃ ৩৭)।

তিনি দুবার (১৩২১ ও ১৩৩০ র.) হ্জ আদায় করেন। শেষবারের হজ্জে তাঁর সাথে প্রায় ১৩০০ জন মুরিদও ছিলেন (পূঃ গ্রঃ পৃঃ ৩৮)। তৎকালে বঙ্গদেশের হজ্জ যাত্রীদেরকে বোম্বাই যেয়ে জাহাজে আরোহণ করতে হত। ফলে তাঁরা বিশেষ দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতেন। তাঁরই চেষ্টায় বাঙ্গালী হাজিদের জন্যে কলকাতা হতেই জাহাজের ব্যবস্থা করা হয়। (ফুরফুরার পীর হযরত আবু বকর সিদ্দিকী পৃঃ ৩৬-৩৭)।

তিনি একজন কামেল পীর ছিলেন। বঙ্গদেশের প্রতি এলাকায় এবং বাইরেও তাঁর অনেক মুরিদ রয়েছেন। তাঁর মতে শরিয়ত ব্যতীত মারেফাত হয় না। ইবাদত-বন্দেগীতে, কাজ-কর্মে, চাল-চলনে, আচার-অনুষ্ঠানে, রীতি-নীতিতে, মোটকথা সকল ব্যাপারে যিনি শরিয়তের অনুবর্তী হন তিনিই পীর হতে পারেন। তিনি বলতেন, কেবল পীরের বংশেই যে পীরের জন্ম হবে এমন কথা কেতাবে নেই। যে বংশেরই হউক না কেন, যিনি শরিয়ত ও মারেফাত ইত্যাদিতে কামেল হবেন, তিনিই পীর হতে পারবেন। (রুহুল আমীন, হযরত পীর সাহেব কেবলাহর বিস্তারিত জীবনী পৃঃ ২৪৬-৪৭; হাকীকতে ইনসানিয়াত, পৃঃ ৯৮-৯৯)।

তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা। বাংলা ও আসামের শহরে ও গ্রামে তিনি বহু ধর্মসভায় ওয়াজ-নছিহত করেছেন, বিদআতপন্থী ও বে-শরআ পীর-ফকীরদের বিরুদ্ধে তিনি মৌখিক প্রচার ও লেখনীর মাধ্যমে বিরামহীন সংগ্রাম করেছেন। তৎকালে আলেমরা সাধারণত বাংলা শিখতেন না এবং বাংলা ভাষায় কিছু লিখতে আগ্রহী ছিলেন না। সহজ সরল বাংলা ভাষায় সাধারণের বোধগম্য করে শরিয়তের বিধি-বিধান তথা ইসলামী বিষয়াদির ওপর বই-পুস্তক রচনা করতে তিনি তাঁর আলেম ও ইংরেজী শিক্ষিত মুরীদেরকে উৎসাহিত করেন। ফলে রুহুল আমীন (মৃঃ ১৯৪৫), মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবদুল হাকীম (বিখ্যাত তাফসীরকারক), ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ আরও অনেকে এ কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

তাঁর অনুমোদনক্রমে অথবা তাঁর নির্দেশে লিখিত এ ধরণের কেতাব-পুস্তকের সংখ্যা হাজারের অধিক হবে। মাওলানা রুহুল আমীন একাই প্রায় ১৩৫ খানা পুস্তকের রচয়িতা। তাঁর নির্দেশে লিখিত বা অনুমোদন প্রাপ্ত কয়েকখানা বইয়ের নাম উল্লেখ করা যায়। যথাঃ আক্কায়েদে ইসলাম, তাসাওউফ, ছিরাজুস ছালেকীন, পীর-মুরিদতত্ত্ব, বাতেল দলের মতামত, নছীহতে সিদ্দিকীয়া, ফাতওয়ায়ে সিদ্দিকীয়া, তালিমে তরীকত, এরশাদে সিদ্দিকীয়া ইত্যাদি। তরীকত দর্পণ বা তাছাওউফ তত্ত্ব বইটি আবু বকর সিদ্দিকীর মুখ নিঃসৃত বাণীর সংগ্রহ (হাকীকতে ইনসানিয়াত, ৯৬-৯৭)।

তিনি নিজেও একজন সুলেখক ছিলেন। পত্র-পত্রিকায় তাঁর বহু বিবৃতি, কিছু প্রবন্ধ ও লিখিত ভাষণ প্রকাশিত হয়েছে। (শরিয়তে এসলাম, আল-এসলাম ও ছুন্নত আল-জামাত পত্রিকার পুরাতন সংখ্যাগুলো)। তাঁর রচিত তারিখুল ইসলাম (বাংলা), কাওলুল হাক (উর্দু) এবং অছীয়তনামা (বাংলা) প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আদিল্লাতুল-মুহাম্মাদিয়া নামে আরবিতে একটি কেতাবও রচনা করেছেন, কিন্তু উহা প্রকাশিত হয়নি (দ্রঃ ফুরফুরা শরীফের হযরত পীর সাহেব (রহ.)-এর মত ও পথ, পাবনা হতে রমজান আলী কর্তৃক প্রকাশিত, পৃঃ ৬, বাংলাদেশের পীর-আউলিয়াগণ, পৃঃ ৪১-৫১)।

মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্যে তিনি যথেস্ট চেষ্টা করেন। মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকার সংস্কারের জন্যে তিনি দাবি জানান। যুগোপযোগী শিক্ষা গ্রহণ করতে তিনি মুসলমানদেরকে উপদেশ দেন, বিশেষত ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের প্রতি তিনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বালক-বালিকাদেরকে ইবতেদায়ী তালীম (প্রাথমিক শিক্ষা)। ইসলামী তরীকা অনুযায়ী ও ইসলামী পরিবেশে দেয়ার জন্যে তিনি জোর তাকীদ করেন। তাঁর মতে নারী-শিক্ষাও জরুরি, তবে পর্দার সাথে। তাদের জন্যে, বিশেষতঃ উচ্চশ্রেণীর বেলায় পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে তিনি উপদেশ দেন (হাকীকাতে ইনসানিয়াত পৃঃ ৬৬-৭৪, ১৪০; শরিয়তে এসলাম পত্রিকা, ৩য় বর্ষ, ১০ সংখ্যায়)।

তাঁর চেষ্টায় বঙ্গদেশের নানা স্থানে প্রায় ৮০০ মাদ্রাসা ও ১১০০ মসজিদ স্থাপিত হয়েছিল। তাঁর নিজ গ্রামে তিনি একটি  ওল্ড স্কীম  ও একটি  নিউ স্কীম মাদ্রাসা এবং একটি ভাল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (পৃঃ গ্রঃ পৃঃ ৬৫-৬৬)। ১৯২৮ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম গভর্নিং বডী গঠিত হয়। তিনি উহার সদস্য ছিলেন (আবদুস সাত্তার, তারিখ ই-মাদ্রাসা ই-আলিয়া, ঢাকা, ১৯৫৯, পৃঃ ৮৪-৮৫)।

সমাজ সংস্কারক হিসেবে আবু বকর সিদ্দিকীর অবদান রয়েছে। তিনি মুসলিম সমাজ হতে শিরক, বিদআত ও অনৈসলামী কাজকর্ম দূর করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেন। তাঁর পরামর্শ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৩১৭/১৯১১ সনে আঞ্জুমানে ওয়ায়েজীন নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। (আনিসুজ্জামান, মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্রিকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৬৯, পৃঃ ১২৫)। এর উদ্দেশ্যাবলীর মধ্যে ছিল মুসলিমদেরকে হেদায়েত করার জন্যে ওয়াজ নছীহাত-এর ব্যবস্থা করা, খৃষ্টান মিশনারীদের কার্যকলাপের প্রতিবিধান করা ও অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করা। এ আঞ্জুমানের প্রচেষ্টার বেশ কিছু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন (৯ ইসলাম দর্শন, ১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, শ্রাবণ, ১৩২৭; মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র, পৃঃ ৩২৫)। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ আঞ্জুমানের সভাপতি ছিলেন।

জামাইয়াত-ই ওলামা-ই-হিন্দ ১৯১৯ ইংরেজী সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। উহার একটি শাখা জামইয়াত ই-ওলামা ই-বাংলা (ও আসাম)। মাওলানা সিদ্দিকী শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন এবং আযাদী আন্দোলনে অংশ্রগহণ করেছিলেন। এর এক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফাতে পূর্ণরূপে আমল করে দেশ ও কওমের খেদমতের জন্যে আলেমদেরকে রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতিতে যোগ দেয়া আবশ্যক। (শরিয়তে ইসলাম, ১০ বর্ষ ৮ম সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৪২)। তিনি আরো বলেছিলেন, রাজনীতি ক্ষেত্র হতে আলেমদেরকে সরে পরার জন্যে আজ মুসলিম সমাজে নানাবিধ অন্যায় ও বেশরা কাজ হচ্ছে (পৃঃ সা.)।

কলকাতায় ১৯২৬ সালে জামইয়াত-ই-ওলামা-ই-হিন্দের বার্ষিক সভায় অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হলে তিনি উহার বিরোধিতা করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন-আইন অমান্য আন্দোলনের ফলে শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট ও মহা ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। স্বরাজ স্বাধীনতা সকলের কাম্য,উহা লাভ করার জন্যে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করা অবশ্য প্রয়োজন, নতুবা তার ফল হবে ভয়ংকর বিষময়। ভারতের মুসলমানরা এ বিষয়ে বহু পশ্চাতে পড়ে আছে। তারা সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষায় নিতান্ত পশ্চাৎপদ; সুতরাং তাদেরকে শিক্ষা, সংগঠন প্রভৃতি বিষয়ে উন্নত করতে হবে, নতুবা মহাসর্বনাশ অনিবার্য। আইন অমান্য আন্দোলন হতে সম্পুর্ণ পৃথক থাকা বিশেষ প্রয়োজন। (শরিয়তে ইসলাম, ৫ম বর্ষ, আষাঢ় সংখ্যা, পৃঃ ১৪২-৪২)। ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দের প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি তার মুরিদান, মুতাকিদীন ও সাধারণ মুসলিমদেরকে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ড কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দিতে অনুরোধ করেছিলেন (ছুন্নত-অল-জামাত পত্রিকা, ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ৫৬, হাকীকতে ইনসানিয়াত পৃঃ ২৪৬)।

জমিয়তের সভাপতি হিসেবে তিনি সৌদী আরবের সুলতান আবদুল আজীজ ইবনে সৌদকে শরিয়ত বিরোধী কার্যাদি রোধ সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করে ১৩৫১ হিজরীতে পত্র লিখেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং আরো চেষ্টা করা হবে বলে বাদশাহ তাঁর পত্রের জবাব দিয়েছিলেন (হাকীকতে ইনসানিয়াত, পৃঃ ১১৫-১৭)।

তৎকালীন সমাজে সংবাদপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তিনি এ কথাটি ভালভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আর্থিক সংকটে পতিত হয়েছে, এমন অনেক পত্রিকাকে তিনি নিজ তহবিল হতে অথবা চাঁদা সংগ্রহ করে সাহায্য করেছেন (হাকীকতে ইনসানিয়াত, ২৯)। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় যে সকল পত্র-পত্রিকা পকাশিত হয়েছিল উহার কয়েকটির নাম উল্লেখ কর হলঃ (১) মিহির ও সুধাকর (সাপ্তাহিক), সম্পাদক, শেখ আবদুর রহিম, ১ম প্রকাশ, ১৮৯৫; (২) নবনূর (মাসিক), সম্পাদক, সৈয়দ এমদাদ আলী, ১ম প্রকাশ, ১৯০৩, (৩) মোহাম্মদী (সাপ্তাহিক), সম্পাদক মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, ১ম প্রকাশ ১৯০৮, (৪) সুলতান (সাপ্তাহিক), পরবর্তীকালে দৈনিক, সম্পাদক, প্রথমে রেয়াজুদ্দিন আহমদ ও পরে মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, ১ম প্রকাশ, ১৯০২; (৫) মুসলিম হিতৈষী (সাপ্তাহিক), সম্পাদক শেখ আবদুর রহিম, ১ম প্রকাশ ১৯১১; (৬) ইসলাম দর্শন (মাসিক), আঞ্জুমানে ওয়ায়েজীনের মুখপত্র, সম্পাদক, মোঃ আবদুল হাকিম ও নূর আহম্মদ, ১ম প্রকাশ, ১৯২০, (৭) হানাফী (সাপ্তাহিক), সম্পাদক, মোহাম্মদ রুহুল আমীন, ১ম প্রকাশ, ১৯২৬; (৮) শরিয়তে এসলাম (মাসিক), সম্পাদক, আহমদ আলী এনায়েতপুরী, ১ম প্রকাশ, ১৯২৬।

তাঁর খলিফাদের সংখ্যাও অনেক। তারা তাঁর অনুসরণে কাজ করে গিয়েছেন। ফলে তাঁর এন্তেকালের পরও তাঁর আরদ্ধ কাজে ছেদ পড়েনি। তাঁর পাঁচ পুত্র। প্রথম পুত্র শাহ সুফী আবু নসর মুহাম্মদ আবদুল হাই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পুত্ররা সকলেই ইলম-ই-শরিয়াতে জ্ঞান সম্পন্ন এবং তাঁর খলিফা ছিলেন।

তিনি ১৯৩৪ খৃঃ হতে বহুমূত্র রোগে ভুগছিলেন। ১৯৩৮ খৃঃ তাঁর আরো কিছু রোগ দেখা দেয়। ফলে তিনি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েন। তখন তিনি চিকিৎসার জন্যে কলকাতা গমন করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। ঐ বৎসরে ডিসেম্বর মাসে তিনি ফুরফুরায় ফিরে যান। ১৯৩৯ খৃঃ মার্চ মাসের ৫, ৬ ও ৭ তারিখে ইসাল-ই-ছওয়াব অনুষ্ঠানে হাজার হাজার ভক্তের সাথে তিনি নিয়মাফিক দেখা-সাক্ষাৎ করেন ও তাঁদেরকে যথারীতি তালিমদেন। তিনি মাহফিলের আখেরী মুনাজাতও পরিচালনা করেন।

২৫ মুহাররাম, ১৩৫৮ হিঃ/ ৩ চৈত্র, ১৩৪৫ বঃ/১৭ মার্চ, ১৯৩৯ খৃঃ শুক্রবার প্রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ফুরফুরার মিয়াপাড়া মহল্লায় তাঁকে দাফন করা হয়। এখনো প্রতি বৎসর ফাল্গুনের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখে সেখানে ইসাল ই-ছাওয়াব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

শাহ আবু বকর সিদ্দিকী সে যুগের একজন শ্রেষ্ঠ হাদী ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে সে যুগের অন্যতম মুজাদ্দিদ বলেও আখ্যাযিত করেছেন। (হাকীকতে ইনসানিয়াত, পৃঃ ১২৫)। তাঁর কিছু কারামাতেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। (পূঃ গ্রঃ পৃঃ ১৮৫-১৯১)।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?