কুরবানীর পশুতে অংশ বা ভাগে কুরবানী দেওয়া কি জায়েজ?

عن جابرٍ، قال: خرجنا مع رسولِ الله صلى الله عليه و سلم مُهِلِّيْنِ بالحَجِّ فأمرنا رسول الله صلى الله عليه و سلم أن نشترِكَ في الإبل والبقرِ، كل سبعةٍ منا في بَدَنَةٍ. رواه مسلم

“জাবের (রাযি:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা নবী (সা:) এর সাথে হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হলাম। অতঃপর তিনি (সা:) আমাদের উট ও গরুতে শরীক হওয়ার আদেশ দেন। আমাদের মধ্যে প্রত্যেক সাত জনকে একটি উটে”। [মুসলিম, অধ্যায়, হাজ্জ, অনুচ্ছেদ নং ৬২, হাদীস নং ৩৫১]

عن جابر بن عبد الله، قال: حججنا مع رسول الله صلى الله عليه و سلم، فنحرنا البعير عن سبعة، والبقرة عن سبعة. رواه مسلم

আবদুল্লার পুত্র জাবির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হজ্জ করলাম। অতঃপর সাত জনের পক্ষে একটি উট নহর করলাম এবং সাত জনের পক্ষে একটি গাভী। [মুসলিম, অধ্যায়, হাজ্জ, অনুচ্ছেদ নং৬২, হাদীস নং ৩৫১]
এ প্রসঙ্গে জাবের (রাযি:) কর্তৃক বর্ণিত আরো কয়েকটি হাদীস সহীহ মুসলিমের উপরোক্ত অনুচ্ছেদে দেখা যেতে পারে।

উযহিয়া বা কুরবানীতে শরীক হওয়ার প্রমাণ:
উপরে বর্ণিত হদীসগুলিতে শরীক হওয়ার বিষয়টি যেহেতু হজ্জ-উমরার হাদ্ঈতে সংঘটিত হয়েছে, তাই অনেকে হয়ত বিষয়টা হাদ্ঈর সাথে সম্পৃক্ত মনে করতে পারে, যদিও তা শুধু হাদ্ঈর সাথে নির্দিষ্ট নয়। সামনে  এ প্রসঙ্গে আলোচনা আসছে। তবুও এখন আমরা উযহিয়া বা কুরবানীতে শরীক হওয়ার প্রমাণ নির্দিষ্ট ভাবে জানবো ইনশাআল্লাহ।

عن ابن عباس قال: كنا مع رسول الله صلى الله عليه و سلم في سفرِ فحضر الأضحى، فاشتركنا في البقرة سبعة و في البعير عشرة. [رواه الترمذي والنسائي وابن ماجه]

ইবনে আব্বাস (রাযি:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর সময় উপস্থিত হল। তাই আমরা একটি গাভীতে সাত জন শরীক হলাম এবং উটে দশ জন। [তিরমিযী, অধ্যায়, আযাহী, অনুচ্ছেদ নং ৭, হাদীস নং১৫৩৭/ নাসাঈ, অধ্যায়, যাহাইয়া, অনুচ্ছেদ নং ১৫ হাদীস নং ৪৪০৪/ ইবনু মাজাহ, অধ্যায়, আযাহী, নং ৩১৩১/ মুসনাদ আহমদ,৩/৩০৩]
হাদীসটিকে ইমাম তিরমিযী হাসান বলেছেন এবং শাইখ আলবানী (রহ) সহীহ বলেছেন। [দেখুন সুনান আত-তিরমিযী হাদীস নং ১৫০১ শাইখ আলবানীর হুকুম সহ।]
উপরোক্ত হাদীস থেকে মুহাদ্দিসগণ যা বুঝেছেন:
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুহাদ্দিসগণ তাঁদের হাদীস গ্রন্থে যেই সব বাব/অনুচ্ছেদ নির্ধারণ করেন, সেটাই তাঁদের ফিক্হ তথা বুঝ হিসাবে পরিচিত। তাই আমরা এখানে দেখবো যে, উপরোক্ত হাদীসটি বিভিন্ন মুহাদ্দিসগণ কোন্ নামের অনুচ্ছেদে বর্ণনা করেছেন বা তাঁরা সেই অনুচ্ছেদের শিরোনাম কী নির্ণয় করেছেন, যার মাধ্যমে আমাদের বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে।
ক- ইমাম তিরমিযী (রহ) হাদীসটি যেই অনুচ্ছেদে বর্ণনা করেছেন, তার শিরোনাম হচ্ছে, ‘বাবুন্ ফিল্ ইশরাকি ফিল্ উয্ হিয়া’ । অর্থাৎ কুরবানীতে শরীক হওয়ার অনুচ্ছেদ। অতঃপর তিনি হুদায়বিয়ায় উট ও গরুতে ৭ জন করে শরীক হয়ে কুরবানী করার আর একটি হাদীস বর্ণনা করেন এবং বলেন:

والعمل على هذا عند أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم و غيرهم.

‘এর উপর সাহাবা এবং অন্যান্য আহলে ইলমগণের আমল রয়েছে’।
এই বাক্যটির ব্যাখ্যায় সাহেবে তুহ্ফা মুবারক পূরী বলেন: ‘অর্থাৎ হাদ্ঈ ও কুরবানীর উট ও গরুতে সাত জন শরীক হওয়ার বৈধতার (আমল)’। [তুহ্ফাতুল আহ্ ওয়াযী,৫/৭৩]
খ- ইমাম নাসাঈ যেই অনুচ্ছেদে হাদীসটি নিয়ে আসেন, তার নামকরণ করা হয় এই ভাবে: ‘বাবু মা তুজযিউ আনহুল্ বাদানাতা ফিয্ যাহাইয়া’। অর্থ, অনুচ্ছেদ, কুরবানীতে একটি উট যত জনের পক্ষে যথেষ্ট’। [নাসাঈ, অধ্যায়, যাহাইয়া, অনুচ্ছেদ নং ১৫]
গ- ইবনু মাজাহ আযাহী/কুরবানী অধ্যায়ে যেই অনুচ্ছেদে হাদীসটি উল্লেখ করেন,তার শিরোনাম এইরূপ: ‘বাবু আন্ কাম্ তুজযিউল্ বাদানাতা ওয়াল্ বাক্বারাহ’। অর্থ, অনুচ্ছেদ, একটি গরু ও উট কত জনের পক্ষে যথেষ্ট’? [হাদীস নং ৩১৩১]
ইমাম শাওকানী (রহ) আলোচ্য হাদীসের শেষাংশ (এবং একটি উট দশ জনের পক্ষে) এর ব্যাখ্যায় বলেন: ‘এটা দলীল যে কুরবানীতে একটি উট ১০ জনের পক্ষে যথেষ্ট’। [নায়লুল আউতার,৫/১৩৪]
হুদাইবিয়ার ঘটনায় সাহাবিগণ আল্লাহর রাসূলের সাথে একটি উট ও গরু সাত জনের পক্ষে কুরবানী করেন মর্মে যেই হাদীসটি মুসলিম সহ অন্যান্য মুহাদ্দিস বর্ণনা করেন। সেই সম্পর্কে সাহেবে আউনুল মা’বুদ বলেন: ‘সুবুলে বলা হয়েছেঃ হাদীসটি উট ও গরুতে শরীক হওয়া জায়েজের প্রমাণ এবং উভয়ে সাত জনের পক্ষে যথেষ্ট। এটা হাদ্ঈর ক্ষেত্রে এবং কুরবানীকে এর উপর কিয়াস করা হবে; বরং কুরবানীর সম্পর্কে নাস বা দলীল এসেছে’।[আউনুল মা’বূদ,৭/৩৬২] অতঃপর তিনি ইবনে আব্বাস (রাযি:) থেকে বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করেন, যাতে গরুতে ৭ জন এবং উটে ১০ জন শরীক হওয়ার বর্ণনা এসেছে।
মুহাদ্দিসগণের উপরোক্ত অনুচ্ছেদ সমূহ ও বিদগ্ধ উলামাগণের ব্যাখ্যানুযায়ী আমরা একথা স্পষ্ট রূপে বুঝতে সক্ষম যে, হাদীসটি থেকে তাঁরা গরু ও উটের কুরবানীতে শরীক হওয়ার বৈধতা বুঝেছেন, মুকীম ও মুসাফিরের মধ্যে পার্থক্য করা ছাড়াই। অর্থাৎ হাদীসটি কেবল সফর অবস্থায় কুরবানীতে শরীক হওয়ার সম্পর্কে নির্দিষ্ট, এমন নয়। তাই তাঁদের কেউই এটা সফরের সাথে নির্দিষ্ট, এমন কোন অনুচ্ছেদ লেখেন নি আর না ব্যাখ্যাকারীগণ সেই দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
উল্লেখ থাকে যে, একটি উট কত জনের পক্ষে যথেষ্ট? এ বিষয়ে মত ভেদ রয়েছে। জমহূর সাত জনের পক্ষে মনে করেন কিন্তু ইসহাক্ব বিন রাহ্ ওয়াইহ্ এবং ইবনু খুজাইমা ১০ জনের পক্ষে মনে করেন। [নায়লুল আউত্বার,৫/১৫৭/ তুহফাতুল্ আহওয়াযী,৫/৭২]
কুরবানীতে একাধিক ব্যক্তির শরীক হওয়া সম্পর্কে ফুকাহাগণের মতামত:

১- ইমাম নাওয়াভী বলেন: ‘কুরবানীর উদ্দেশ্যে সাত ব্যক্তির একটি উটে কিংবা গরুতে শরীক হওয়া জায়েজ। তারা সকলে এক পরিবারের হোক কিংবা বিভিন্ন পরিবারের। কিংবা কারো গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য থাক (আর অন্যদের নৈকট্য উদ্দেশ্য) এমতাবস্থায় নৈকট্য কামনাকারীর পক্ষে তা যথেষ্ট। সেই কুরবানীটা মানতের হোক কিংবা নফল কুরবানী। এটা আমাদের মাজহাব এবং এটাই আহমদ, দাঊদ ও জমহূর উলামার কথা। তবে দাঊদ নফল কুরবানীতে শরীক বৈধ বলেছেন ওয়াজিবে নয়’। [কিতাবুল মাজমূ, নাওয়াভী,৮/৩৭১] অতঃপর তিনি প্রমাণ স্বরূপ সহীহ মুসলিমে জাবের (রাযি:) হতে বর্ণিত ঐ হাদীসদুটি উল্লেখ করেন, যা আমরা হাদ্ঈতে শরীক হওয়ার প্রমাণ শিরোনামে উল্লেখ করেছি।
২- ইবনু কুদামাহ (রহ) তাঁর প্রসিদ্ধ মুগনী গ্রন্থে ১৭৬৮ নং মাসআলার ব্যাখ্যায় বলেন: ‘ফলকথা উট ও গরুতে সাত জন শরীক হয়ে কুরবানী দেওয়া বৈধ। সেটা ওয়াজিব হোক কিংবা নফল। তারা সকলে নৈকট্যের আশাবাদী হোক কিংবা কেউ নৈকট্যের আর অন্য কেউ গোশতের। এটাই শাফেয়ী বলেন। মালেক বলেন: হাদ্ঈতে শরীক হওয়া জায়েজ নয়’। [আল মুগনী, ১৩/৩৯২]
৩- ইনবু হায্ম (রহ) তাঁর আল্ মুহাল্লা গ্রন্থে ৯৮৪ নং মাস্আলা বর্ণনায় বলেন: ‘একটি কুরবানীতে শরীক হওয়া বৈধ, সেই দলটি একটি বাড়ির সদস্য হোক কিংবা বিভিন্ন বাড়ির এবং এক জনের একাধিক কুরবানী করাও বৈধ, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুটি ভেড়া কুরবানী করেন যেমন একটু আগে বর্ণনা করেছি এবং তিনি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অতিরিক্ত করতে নিষেধ করেন নি। কুরবানী একটি সৎ কাজ। আর বেশী বেশী সৎ কাজ করা উত্তম।
আবু হানীফা, সুফ্ইয়ান সাওরী, আওযায়ী, শাফেয়ী, আহমদ, ইসহাক্ব, আবু সাউর এবং আবু সুলায়মান বলেন: একটি গরু কিংবা একটি উট সাত কিংবা তার থেকে কম সংখ্যকের পক্ষে যথেষ্ট, তারা পারস্পারিক পরিচিত হোক অথবা না হোক। তারা তাতে শরীক হতে পারে, তবে এর থেকে বেশী সংখ্যার পক্ষে যথেষ্ট হবে না’। [আল্ মুহাল্লা, ইবনু হায্ ম,৪/৩৮১ পৃঃ, দারুল ফিকরে ছাপা]
৪- মুতাআখ্খির ফকীহদের মধ্যে সাইয়্যেদ সাবেক (রহ) বলেন: ‘কুরবানী যদি উট কিংবা গরু হয়, তাহলে তাতে শরীক হওয়া জায়েজ। আর একটি গরু কিংবা একটি উট সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে, যদি তারা সকলে কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য চায়। জাবের (রাযি:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমরা হুদায়বিয়ায় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে একটি উট সাত জনের পক্ষে এবং একটি গরু সাত জনের পক্ষে কুরবানী করেছিলাম”। মুসলিম, আবু দাঊদ এবং তিরমিযী। [ফিকহুস্ সুন্নাহ, সায়্যেদ সাবিক,৩/১৯৮]
এতক্ষণে আমরা বিষয়টির সম্পর্কে চার জন বিশেষ ইসলামী পণ্ডিতের মন্তব্য জানলাম। দেখা যাচ্ছে তাঁরা সকলে সফর ও মুকীমের পার্থক্য ছাড়াই উট কিংবা গরুর কুরবানীতে সাত ব্যক্তির শরীক হওয়া বৈধ মনে করছেন। তবে তাদের কাছে যেই বিষয়টির মতভেদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা হল: সেই সাত ব্যক্তির একই পরিবারভুক্ত হওয়া আবশ্যক না বিভিন্ন পরিবারের ৭ জন ব্যক্তির পক্ষেও সেই উট-গরুতে শরীক হওয়া চলবে?

আরো একটি মতভেদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ৭ জন শরীক হওয়ার সময় যদি কারো উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য না থাকে; বরং গোশত খাওয়া উদ্দেশ্য হয়, তাহলে শরীক হওয়া যাবে কি যাবে না? কিন্তু কুরবানীতে শরীক হওয়ার বৈধতায় তাঁদের মতভেদ নেই।

এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, তাঁরা হাদ্ঈ ও উযহিয়াতে শরীক হওয়ার বিষয়টি আলাদা আলাদা ভাবে দেখেন নি; বরং হাদ্ঈতে শরীক হওয়ার দলীলগুলিকেই কুরবানীতে শরীক হওয়ার দলীল হিসাবে দেখেছেন। তাই তাঁদের ফিক্হ/জ্ঞান এবং তাঁদের ইস্তিদ্লাল/প্রমাণকরণ পদ্ধতি আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ হতে পারে না কি?
উট কিংবা গরুর ভাগে শরীক হয়ে কুরবানী দেয়া সম্পর্কে সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদের ফাতওয়াঃ
প্রশ্ন: কুরবানীতে শরীক হওয়া জায়েজ কি, মুসলিমদের কত সংখ্যক লোক তাতে শরীক হতে পারে, তারা কি এক পরিবারের হবে এবং কুরবানীতে শরীক হওয়ার বিষয়টি কি বিদআত?
উত্তর: [তারা প্রথমে একটি ছাগলের কুরবানী, যা একটি বাড়ির সদস্যদের পক্ষে যথেষ্ট তা উল্লেখ করেন, অতঃপর বলেন] এবং একটি উট ও একটি গরু সাত জনের পক্ষে যথেষ্ট। সেই সাত জন একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হোক কিংবা বিভিন্ন পরিবারের, তাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকুক কিংবা না থাকুক; কারণ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  সাহাবিদের মধ্যে প্রত্যেক সাত জনকে একটি উটে ও গরুতে শরীক হওয়ার অনুমতি দেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম। [ফাতাওয়াল্ লাজনা আদ্দায়িমাহ,১১/৪০১-৪০২,ফাতওয়া নং ২৪১৬]

Comments

Popular posts from this blog

হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু'র প্রকৃত হত্যাকারী কে....?

নামধারী আহলে হাদিস বিদাতী ফিরকার ইসলাম বিরোধী ৫০টি ভ্রান্ত মতবাদ

ইসলামী গজল গাওয়া বা শোনা কি জায়েজ?